কেজিবি (KGB), পুরো নাম Komitet Gosudarstvennoy Bezopasnosti, সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান গোয়েন্দা এবং নিরাপত্তা সংস্থা হিসেবে সুপরিচিত ছিল। ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থা সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা রক্ষা, গুপ্তচরবৃত্তি, তথ্য সংগ্রহ, এবং বিদেশে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন পর্যন্ত, কেজিবি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অত্যন্ত প্রভাবশালী একটি সংস্থা হিসেবে পরিচিতি পায়। এই প্রবন্ধে কেজিবির কার্যক্রম, তাদের ভূমিকা এবং গুরুত্বপূর্ণ অভিযানসমূহ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
কেজিবির ইতিহাস ও প্রতিষ্ঠা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ বাড়তে থাকে। আমেরিকা ও পশ্চিমা শক্তির সাথে তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থার প্রয়োজন দেখা দেয়। এর প্রেক্ষিতে ১৯৫৪ সালে কেজিবির প্রতিষ্ঠা করা হয়। সংস্থাটি সোভিয়েত নিরাপত্তা এবং গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণে দক্ষতার পরিচয় দেয় এবং ক্রমে বিশ্বজুড়ে কুখ্যাতি লাভ করে।
কেজিবির কার্যক্রম ও ভূমিকা
কেজিবি সোভিয়েত রাষ্ট্রের জন্য বিভিন্ন ধরণের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতো। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষা থেকে শুরু করে বিদেশে গুপ্তচরবৃত্তি এবং প্রভাব বিস্তার করা পর্যন্ত কেজিবির কার্যক্রম বিস্তৃত ছিল। সংস্থার কার্যক্রমের মূল বিভাগগুলো নিম্নরূপ:
১. অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা
কেজিবি সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তৎপর ছিল। তারা রাজনৈতিক বিদ্রোহ দমন, গোপন কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ এবং সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী ও সন্দেহভাজনদের নজরদারি করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করতো। কেজিবি সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশে কাজ করত, এবং সরকারের বিরোধীদের আটক ও নির্যাতন করার দায়িত্ব পালন করতো।
২. গুপ্তচরবৃত্তি ও বিদেশী গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ
কেজিবি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা এজেন্টদের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ ও গুপ্তচরবৃত্তি কার্যক্রম চালাতো। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর উপর নজরদারি করতে তারা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে কাজ করত। কেজিবির এজেন্টরা অন্যান্য দেশে সোভিয়েত প্রভাব বিস্তারের জন্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক তথ্য সংগ্রহ করতো। ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ে এই সংস্থা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করে সোভিয়েত সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করেছিল।
৩. প্রোপাগান্ডা ও মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ
সোভিয়েত ইউনিয়নের আদর্শকে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দিতে কেজিবি প্রোপাগান্ডা ও মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ চালাতো। তারা বিভিন্ন দেশে কমিউনিস্ট আদর্শ প্রচারের জন্য গোপন প্রচারণা চালাতো এবং প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর বিরোধিতা করত। তাদের প্রভাবশালী কৌশলের মাধ্যমে কেজিবি সোভিয়েত আদর্শকে সমর্থন করতো এবং বিশ্বব্যাপী কমিউনিস্ট দলগুলোর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতো।
৪. পরমাণু প্রযুক্তি চুরি ও প্রতিরক্ষা ক্ষমতা বৃদ্ধি
কেজিবি একাধিকবার পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর পরমাণু প্রযুক্তি চুরি করার জন্য গুপ্তচর পাঠায়। তারা আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন প্রযুক্তি গবেষণাগার থেকে অত্যন্ত গোপনে তথ্য সংগ্রহ করে সোভিয়েত প্রতিরক্ষাকে আরও শক্তিশালী করে তুলেছিল। ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের পরমাণু প্রতিরক্ষা সক্ষমতায় উন্নতি করতে সক্ষম হয়।
কেজিবির উল্লেখযোগ্য অভিযানসমূহ
কেজিবির অসংখ্য অভিযান ছিল, যা সারা বিশ্বের নজর কেড়েছে। নীচে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য অভিযানের তালিকা দেওয়া হলো:
১. ফিল্ডস অফ দ্য কোল্ড ওয়ার (Fields of the Cold War)
ঠান্ডা যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পর্ক যখন তীব্র উত্তেজনাপূর্ণ ছিল, তখন কেজিবি আমেরিকান প্রশাসন এবং সামরিক বাহিনীর উপর নজরদারি করার জন্য বিশাল একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে। তারা তথ্য সংগ্রহ, গুপ্তচরবৃত্তি এবং সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রভাব বিস্তারের জন্য বিভিন্ন দেশে ছদ্মবেশী এজেন্ট প্রেরণ করতো।
২. ক্যামব্রিজ ফাইভ (Cambridge Five)
কেজিবির অন্যতম আলোচিত এবং সফল গুপ্তচর চক্র ছিল “ক্যামব্রিজ ফাইভ,” যারা ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। কেজিবি এই সদস্যদের সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে নিয়োগ করে এবং ব্রিটিশ গোয়েন্দা তথ্য তাদের কাছে সংগ্রহ করতো। ক্যামব্রিজ ফাইভের মাধ্যমে কেজিবি যুক্তরাজ্যের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সামরিক এবং কূটনৈতিক তথ্য পেয়েছিল।
৩. দ্য আফগানিস্তান অভিযান
১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান চালায় এবং সেখানে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। কেজিবি আফগানিস্তানে তাদের এজেন্টদের প্রেরণ করে এবং দেশটির রাজনৈতিক কাঠামোতে প্রভাব বিস্তার করে। এই অভিযান সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়, কারণ দীর্ঘকালীন যুদ্ধ এবং আন্তর্জাতিক চাপ সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।
৪. ইউরি নোসেঙ্কো ও সিআইএ
কেজিবির অভ্যন্তরীণ গুপ্তচরবৃত্তির আরো একটি আলোচিত ঘটনা হল ইউরি নোসেঙ্কো নামে এক উচ্চপদস্থ কেজিবি কর্মকর্তার সিআইএ-তে আশ্রয় নেওয়া। নোসেঙ্কো আমেরিকার কাছে কেজিবির বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ফাঁস করে। এর ফলে সিআইএ কেজিবির অনেক গোপন পরিকল্পনার সম্পর্কে জানতে পারে, যা পরবর্তীতে সোভিয়েত নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করেছিল।
কেজিবির পতন এবং এর উত্তরাধিকার
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সাথে সাথে কেজিবির কার্যক্রমও ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের পর কেজিবির স্থলে নতুন রুশ গোয়েন্দা সংস্থা FSB এবং SVR গঠন করা হয়। FSB মূলত রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা দেখভাল করে, এবং SVR আন্তর্জাতিক গুপ্তচরবৃত্তির দায়িত্ব পালন করে। কেজিবির এজেন্ট এবং তাদের কার্যপ্রণালী এই নতুন সংস্থাগুলোতে রয়ে গেছে এবং আজও রাশিয়ার গোয়েন্দা কার্যক্রমে প্রভাব বিস্তার করছে।
কেজিবি সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। তাদের গুপ্তচরবৃত্তি, তথ্য সংগ্রহ এবং প্রোপাগান্ডা কার্যক্রম সোভিয়েত সরকারের কৌশলগত সফলতার মূল চাবিকাঠি হিসেবে কাজ করেছিল। যদিও এই সংস্থার কার্যক্রম নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে এবং অনেক সময় নির্যাতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে, তবু কেজিবি সোভিয়েত ইউনিয়নের গোয়েন্দা কার্যক্রমের ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল।