বাংলা সিনেমা বা ভারতীয় চলচ্চিত্রের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে প্রভাবশালী পারফরমেন্স আর্টের ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। যেহেতু সিনেমা একটি অঙ্গসংগঠিত শিল্প, যেখানে বিভিন্ন শিল্পমাধ্যম যেমন সঙ্গীত, চিত্রকলা, নৃত্য, নাটক ইত্যাদি মিলে এক নতুন শৈলীতে প্রকাশ পায়, অভিনয় বা পারফরমেন্সের ভূমিকা হয়ে ওঠে সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ। একটি সিনেমা সফলতার অন্যতম কারণ হল চরিত্রের প্রতি অভিনেতার অন্তর্দৃষ্টির গভীরতা এবং তা দর্শকের কাছে উপস্থাপনের জন্য শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতির প্রয়োজনীয়তা। বিশেষ করে বাংলা সিনেমায়, যেখানে বাস্তববাদী কাহিনীর পাশাপাশি সমাজের নানা দিকের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ থাকে, অভিনেতার পারফরমেন্স হয়ে ওঠে চরিত্রের শক্তি ও মনস্তত্ত্বের বহিঃপ্রকাশ।
পারফরমেন্স আর্টের সংজ্ঞা ও তার বাংলা সিনেমায় প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা করা যাক। এখানে “পারফরমেন্স আর্ট” বলতে যে শিল্পমাধ্যমের কথা বলা হচ্ছে, তা এক ধরনের সৃজনশীল প্রদর্শন, যেখানে অভিনেতা বা শিল্পী তার শারীরিক ও মানসিক উপস্থিতি, ভাষা, মুভমেন্ট, ভঙ্গি, সুর, আত্মবিশ্বাস ইত্যাদির মাধ্যমে একধরনের অভিব্যক্তি তৈরি করেন। সিনেমা হলেও এই শৈলী ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। বিশেষত, বাংলা সিনেমায় পারফরমেন্স আর্টের ভূমিকা অতীতের চেয়ে আজকাল আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কারণ এখানে কাহিনীর গভীরতা, চরিত্রের মনস্তত্ত্ব এবং সেসবের মাধ্যমে সামাজিক বা সাংস্কৃতিক বার্তা তুলে ধরা হয়।
পারফরমেন্স আর্টের সংজ্ঞা এবং বাংলা সিনেমায় এর ব্যবহার
পারফরমেন্স আর্ট শব্দটি আধুনিক শিল্পের বিভিন্ন ধারায় ব্যবহৃত হয়, যেখানে শিল্পী তার শরীর, অভিব্যক্তি এবং উপস্থিতি দিয়ে এক ধরনের শিল্পকর্ম তৈরি করেন। সিনেমা, বিশেষ করে বাংলা সিনেমা, একটি পারফরমেন্স আর্টের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। সিনেমায় পারফরমেন্স বলতে অভিনেতার শারীরিক এবং মানসিক সৃজনশীলতার সমন্বয়কে বুঝানো হয়। এখানে পরিচালক এবং অভিনেতা একত্রে মিলে এক একটি চরিত্রের মধ্যে জীবন ও অনুভূতির প্রকৃতির সৃজন করে, যা দর্শকের মনে গভীর প্রভাব ফেলে।
বাংলা সিনেমায় পারফরমেন্সের ইতিহাস বহু পুরনো। সত্যজিৎ রায়ের “পথের পাঁচালি” (১৯৫৫) থেকে শুরু করে ঋত্বিক ঘটকের “মেঘে ঢাকা তারা” (১৯৬০), এবং উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সলিল চৌধুরী, মৃণাল সেন, অরুণ রায়, তাপস সেনগুপ্তের মতো বহু পরিচালকের মাধ্যমে বাংলা সিনেমায় অভিনয় এক নতুন দৃষ্টিকোণ তৈরি করেছে। এদের সিনেমায় পারফরমেন্সে যে শারীরিক ও মানসিক শক্তি কাজ করেছিল, তা আজও বাংলা সিনেমার ইতিহাসে অমর হয়ে আছে।
শারীরিক ভাষা ও অভিব্যক্তি
পারফরমেন্স আর্টে শারীরিক ভাষার এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে। এটি সিনেমার মঞ্চে অভিনয় করার সময় একজন অভিনেতার মনস্তত্ত্ব, অভ্যন্তরীণ অনুভূতি এবং শারীরিক অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে দর্শকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার একটি শক্তিশালী উপায়। বাংলা সিনেমায় এ ধরনের শারীরিক ভাষার ব্যবহার অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং গভীর। শারীরিক ভাষা শুধুমাত্র চরিত্রের একটি বাহ্যিক প্রকাশ নয়, এটি চরিত্রের মনের অবস্থা ও তার যাত্রাকে প্রকাশ করে।
উত্তম কুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অমল রায়, জয়া ভাদুরি, চূর্ণী গাঙ্গুলি—এদের মতো অভিনেতাদের শারীরিক অভিব্যক্তি বাংলা সিনেমায় এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। যেমন, উত্তম কুমারের অভিনয়ে চোখের ভাষা, মুখাবয়বের উজ্জ্বলতা এবং শরীরের নড়াচড়া পুরোপুরি চরিত্রের মনের অবস্থা দর্শকের কাছে স্পষ্টভাবে পৌঁছে দিত। সিনেমার যেকোনো দৃশ্যে তার উপস্থিতি ছিল এক অপ্রতিরোধ্য শক্তি, যার মাধ্যমে সিনেমার আবেগপূর্ণ মুহূর্তগুলো দর্শকের কাছে আরও জীবন্ত হয়ে উঠত।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের চরিত্রের মধ্যে শারীরিক ভাষার অনন্যত্ব লক্ষ্য করা যায়। বিশেষত “অপুর সংসার” চলচ্চিত্রে তিনি চরিত্রের মানসিক অবস্থা, অস্থিরতা এবং একাকীত্বকে তাঁর শরীরের ছোট ছোট অঙ্গভঙ্গি দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। এটি দেখায় যে অভিনয় শুধুমাত্র বক্তৃতা বা সংলাপের মাধ্যমে নয়, বরং শারীরিক ভাষার মাধ্যমে অধিকতর অর্থবহ হতে পারে।
মানসিক প্রস্তুতি এবং চরিত্রে অভ্যন্তরীণ প্রবণতা
পারফরমেন্স আর্টের জন্য শুধুমাত্র শারীরিক প্রস্তুতি নয়, মানসিক প্রস্তুতিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন অভিনেতা যখন একটি চরিত্রে অভিনয় করেন, তখন তাকে শুধুমাত্র শারীরিকভাবে নয়, মানসিকভাবেও চরিত্রটির মধ্যে ডুব দিতে হয়। বাংলা সিনেমার ইতিহাসে অনেক অভিনেতা একাধিক চরিত্রে অভিনয় করেছেন, যারা বিভিন্ন মানসিক অবস্থার মধ্য দিয়ে যান। সেই মানসিক অবস্থার প্রতি যথাযথ উপলব্ধি এবং তার পরিবেশনই একজন অভিনেতার পারফরমেন্স আর্টের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
ধরা যাক, সত্যজিৎ রায়ের “সোনার কেল্লা” সিনেমায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের চরিত্রের মানসিক জটিলতা। তিনি একটি রহস্যময় চরিত্রে অভিনয় করেছেন, যেখানে তার মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা, কৌতূহল এবং আতঙ্ক রয়েছে। এই মানসিক দোলাচলে তার শারীরিক ভাষাও সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়, যা তার চরিত্রের গভীরতাকে আরো শক্তিশালী করে তোলে।
অভিনেতাকে মাঝে মাঝে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয় যেখানে তার মানসিক প্রস্তুতি এবং অভ্যন্তরীণ শক্তি চরিত্রের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকে পর্দায় জীবন্ত করে তোলে। উদাহরণ হিসেবে, ঋত্বিক ঘটকের “মেঘে ঢাকা তারা” ছবির বিষ্ণু চরিত্রটি মনে করা যেতে পারে, যেখানে চরিত্রটি সামাজিক ও মানসিক সংকটে ভুগছে, এবং সেই সংকটই অভিনেতার মনের ভিতর অনুভূতির গভীরতা বৃদ্ধি করে।
অভিনয়ের মধ্যে শারীরিক ও মানসিক সমন্বয়
বাংলা সিনেমায় অভিনয় একটি শারীরিক ও মানসিক সম্মিলিত প্রক্রিয়া। এই শৈলীতে অভিনেতার চরিত্রের মনের অবস্থা ও শারীরিক প্রকাশ একে অপরকে পরিপূরক করে। অভিনয় কখনোই একপেশে হতে পারে না, যেখানে একমাত্র শারীরিক উপস্থাপন বা একমাত্র মানসিক গভীরতা প্রধান থাকবে। সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক বা মৃণাল সেনের মতো পরিচালকের ছবিতে এক ধরনের নিখুঁত সমন্বয় ছিল—যেখানে শারীরিক অঙ্গভঙ্গি, সুর, সংলাপ, এবং মানসিক প্রস্তুতি একসাথে মিলে অভিনয়ের এক নতুন স্তরে চলে যেত।
এটা বলে রাখা ভালো যে, একজন অভিনেতার পারফরমেন্স আর্টের পেছনে অনেক সময় তার নিজস্ব ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, সমাজের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি, এবং শিল্পী হিসেবে তার মানসিক প্রস্তুতির বিষয়টি কাজ করে। বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয়ের জন্য অভিনেতাকে মানসিকভাবে সেই চরিত্রের মধ্যকার সংকট ও আবেগের সাথে একাত্ম হতে হয়। “অপু” (পথের পাঁচালি) অথবা “ফেলুদা” (সোনার কেল্লা)—এই চরিত্রগুলোর মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক দিক এবং শারীরিক প্রকাশের এক গভীর সম্পর্ক ছিল।
অভিনয়ের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব
একজন অভিনেতার শারীরিক এবং মানসিক অভ্যস্ততা কেবল একক সিনেমার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। তার প্রতিটি চরিত্রের মধ্যে যে অভ্যন্তরীণ প্রস্তুতি ও পরিশ্রম থাকে, তা তার পরবর্তী কাজেও প্রতিফলিত হয়। তাই বলা যায়, একজন অভিনেতার অভ্যন্তরীণ শিল্পীভা, মানসিক প্রভাব এবং শারীরিক ভাষা পরবর্তীতে তার ভবিষ্যৎ অভিনয়েও অনুপ্রাণিত করে।
উত্তম কুমারের মতো অভিনেতার ক্যারিয়ার দীর্ঘ এবং ব্যাপক ছিল, যার ফলে তার শারীরিক এবং মানসিক শৈলীতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। প্রথমে অতিরঞ্জিত অভিনয়, পরবর্তী সময়ে সূক্ষ্ম এবং সাবলীল অভিনয়ে তার বিকাশ প্রকৃতই একটি অভিনয়ের সার্থক দৃষ্টান্ত।
বাংলা সিনেমায় পারফরমেন্স আর্টের গুরুত্ব চিরকালীন। এটি একজন অভিনেতার শারীরিক এবং মানসিক প্রস্তুতির মিলনস্থল, যা সিনেমার কাহিনী এবং চরিত্রের গভীরতা দর্শকের কাছে পৌঁছে দেয়। বাংলা সিনেমার ইতিহাসে বহু অভিনেতা ও পরিচালক এই শৈলীতে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছেন, যার ফলে বাংলা চলচ্চিত্র আজও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রশংসিত হয়। চরিত্রের মধ্যে আবেগ, সংকট, সুখ, দুঃখ, প্রেম, বিরহ—সব কিছুই অভিনয়ের মাধ্যমে জীবন্ত হয়ে ওঠে, আর সেই অভিনয়ে শারীরিক এবং মানসিক পারফরমেন্সের সমন্বয় অতুলনীয়।