বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাস দীর্ঘ ও সমৃদ্ধ, তবে একসময় বাণিজ্যিক চিন্তা-ধারা এবং প্রচলিত বিনোদনমূলক ধারার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। মুম্বাইয়ের প্রভাব, দক্ষিণী সিনেমার জনপ্রিয়তা, এবং সামাজিক বাস্তবতা থেকে বিচ্যুত হওয়া, এগুলোর কারণে বাংলা সিনেমার মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি মাঝে মাঝে একধরনের সংকটে পড়েছিল। তবে কিছু চলচ্চিত্র এবং নির্মাতা এমন যুগান্তকারী পরিবর্তন এনে দিয়েছেন, যার কারণে বাংলা সিনেমা ধীরে ধীরে শিল্পের পথে ফিরতে শুরু করে। এই প্রবন্ধে আমরা আলোচনার মাধ্যমে তুলে ধরব কোন সিনেমাগুলোর মাধ্যমে বাংলা চলচ্চিত্রের বাণিজ্যিক মনোভাব থেকে শিল্পমুখী পরিবর্তন ঘটেছে।
বাংলা সিনেমার ইতিহাসে একটি বিশেষ মুহূর্ত আসে যখন সিনেমা শুধুমাত্র বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে নির্মিত হতে থাকেনি, বরং শিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে নির্মাণের প্রতি গভীর মনোযোগ দেওয়া হতে থাকে। ১৯৯০ এবং ২০০০-এর দশকে এমন কিছু চলচ্চিত্র মুক্তি পায়, যা কেবল মাত্র বাংলাদেশের বা ভারতের নয়, আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের পর্যায়েও প্রশংসিত হয়। এই চলচ্চিত্রগুলোর মাধ্যমে বাংলা সিনেমার আধুনিক যুগ শুরু হয় এবং নির্মাতারা শুধুমাত্র বিনোদনের জন্য নয়, বরং শিল্পের, সমাজের ও মানবিক সমস্যার উপস্থাপনার জন্য সিনেমা নির্মাণ করতে শুরু করেন।
১. বাংলা সিনেমার বাণিজ্যিক যুগ
১৯৫০ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত বাংলা সিনেমার ইতিহাস একধরনের ধারাবাহিক বাণিজ্যিক পর্বে গড়ে ওঠে। এই সময়কার বেশিরভাগ সিনেমা সাধারণত পারিবারিক ড্রামা, রোমান্স, ঐতিহাসিক কিংবা ঐতিহ্যবাহী কাহিনির ওপর নির্ভরশীল ছিল। দর্শকদের জন্য মানসম্পন্ন গল্পের পাশাপাশি ছিল মনোরঞ্জনের জন্য সঙ্গীত ও নৃত্যের বেশ বড় অংশ। সিনেমার এই প্রকার শ্রেণি সাধারণত জনপ্রিয়তার জন্য তৈরি হত এবং চলচ্চিত্রের মানের প্রতি তেমন গুরুত্ব দেওয়া হত না।
প্রথম শ্রেণীর বাণিজ্যিক সিনেমা
এই সময়কার বাংলা সিনেমাগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল ‘দেবদাস’ (১৯৫৫), ‘অগ্নিপরীক্ষা’ (১৯৭০), ‘নায়ক’ (১৯৭৭) ইত্যাদি। এসব সিনেমাগুলোর কাহিনির মধ্যে ছিল বিশাল নাটকীয়তা, হৃদয়স্পর্শী সম্পর্ক, অতিরঞ্জিত চরিত্র এবং নিঃস্বার্থ প্রেম-অভিযোগের গল্প। এগুলি বাণিজ্যিকভাবে সফল হলেও, এর মধ্যে মূলত জনগণের বিনোদন এবং প্রেম ও সংবেদনশীলতার উপস্থাপনা ছিল।
এছাড়া, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ (১৯৬৪), ‘ছোঁয়া’ (১৯৭০), ‘বিনোদিনী’ (১৯৭৮) এর মতো ছবিগুলি বিভিন্ন সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কিছু পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছিল, তবে সেগুলি ছিল ঐতিহ্যগত অর্থে বাণিজ্যিক সিনেমারই অংশ। এসব সিনেমার অনেকটাই ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য দর্শকদের আনন্দ দেওয়া, এবং তথাকথিত ‘বাণিজ্যিক’ সিনেমার গণ্ডিতেই ছিল।
২. শিল্পমুখী পরিবর্তনের সূচনা
বাংলা চলচ্চিত্রের শিল্পমুখী পর্বের সূচনা হয় ১৯৮০ এর দশকে। এই সময়কার কিছু সিনেমা, বিশেষ করে সত্যজিৎ রায়, তপন সিংহ, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেনের মতো নির্মাতাদের ছবির প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে বাংলা চলচ্চিত্রে। এই পরিচালকরা ছিলেন মূলত ‘আর্ট ফিল্ম’ বা শিল্পধর্মী সিনেমার পথিকৃৎ। তাঁদের কাজ শিল্পের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা, মানসিকতা, দর্শন এবং আধুনিক সমাজের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ছিল। সত্যজিৎ রায়ের কাজ, যেমন ‘পথের পাঁচালী’, ‘অপুর সংসার’, ‘চারুলতা’ আজও বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে উজ্জ্বল একটি দৃষ্টান্ত। তিনি সিনেমাকে এক নতুন শৈলী দিয়েছিলেন, যেখানে শিল্প ও চিন্তার গভীরতা ছিল।
যদিও সত্যজিৎ রায়ের ছবিগুলো মূলত বিশ্ব চলচ্চিত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে আধুনিক ভাবনা নিয়ে তৈরি করা হত, তবে ১৯৮০-৯০-এর দশকের পরবর্তী বাংলা চলচ্চিত্রে একটি নতুন স্তরের শিল্পমুখী পরিবর্তন ঘটে। অনেক পরিচালক তাঁদের সিনেমায় মনের জগৎ, বাস্তবতার খুঁটিনাটি, মানুষের সমাজ-রাজনৈতিক অবস্থান এবং চরিত্রের গভীরতার দিকে নজর দেন।
৩. অ্যাডভান্সড প্রযুক্তি এবং আধুনিক চলচ্চিত্রের জগৎ
১৯৯০-এর দশকে চলচ্চিত্রের প্রযুক্তিগত উন্নতি এবং বিশ্বব্যাপী এক বৃহত্তর ‘আর্থিক বিপ্লব’ বাংলা চলচ্চিত্রের পরিধিকে আরো বড় করে তোলে। সিনেমার নির্মাণে কম্পিউটার গ্রাফিক্স (CGI) এবং আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে বাণিজ্যিক এবং শিল্পের মাঝখানে একটি ভারসাম্য তৈরী হয়। এই সময়ের মধ্যে বেশ কিছু বাংলা সিনেমা উঠে আসে যেগুলি ভিন্নধর্মী গল্প, সাহসী ভিজ্যুয়াল উপস্থাপনা এবং নির্মাণের জন্য বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়।
৪. ‘বাইশে শ্রাবণ’ (২০০৩): বাংলা চলচ্চিত্রের এক নতুন দিগন্ত
বাংলা সিনেমার শিল্পমুখী যুগের জন্য একটি স্মরণীয় মুহূর্ত ছিল ‘বাইশে শ্রাবণ’ (২০০৩)। ছবিটি বাংলা চলচ্চিত্রের একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ‘বাইশে শ্রাবণ’ পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ-এর একটি অত্যন্ত অভিনব কাজ। এই ছবিটি শুধু বাংলা সিনেমার ঐতিহ্যিক ধারা ভেঙে দেয়নি, বরং একটি নতুন ঢেউ তৈরি করে বাংলা সিনেমাতে।
‘বাইশে শ্রাবণ’ ছিল একটি ভিন্ন ধরনের সিনেমা যা কেবল বাণিজ্যিক সিনেমা হিসেবে নয়, এক সাহিত্যিক আবেগে তৈরি ছবি হিসেবে বাংলার চলচ্চিত্রের এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গঠন করেছিল। এই ছবির মূল ভাবনা ছিল একটি পুরানো ভালোবাসার গল্প, তবে তা খুবই সুনিপুণভাবে উপস্থাপিত হয়েছিল। এর গল্প, সিনেম্যাটোগ্রাফি, গান এবং কাস্টিং – সবকিছুই ছিল এক নতুন মাত্রার। ঋতুপর্ণ ঘোষ তাঁর কাজের মাধ্যমে দেখিয়েছিলেন যে, বাংলা সিনেমার জন্য শুধুমাত্র ‘বাণিজ্যিক’ নয়, ‘শিল্প’ও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
৫. ‘মেঘে ঢাকা তারা’ (১৯৯১) এবং ২০০০ এর পরবর্তী সময়ের দিক পরিবর্তন
একইভাবে, ‘মেঘে ঢাকা তারা’ (১৯৯১) এবং ‘ঘর বাইরে’ (১৯৯২) সিনেমাগুলিও বাংলা চলচ্চিত্রের শিল্পসম্মত দৃষ্টিভঙ্গিকে তুলে ধরেছে। ঋত্বিক ঘটক এবং মৃণাল সেনের কাজগুলি ছিল সামাজিক ও রাজনৈতিক বার্তা নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের পথিকৃত।
এছাড়া, ‘সাহেব, বিবি গোলাম’ (২০০৩), ‘অলকানন্দা’ (২০০৭), ‘অগ্নিসাক্ষী’ (২০০৯) ইত্যাদি ছবিগুলি শিল্পসচেতন নির্মাতাদের কাজের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসাবে উঠে আসে। এসব সিনেমাগুলো তৎকালীন বাংলা সিনেমার দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমাজের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে গভীর আলোচনা করেছিল।
৬. বাণিজ্যিক ও শিল্পের মাঝে ভারসাম্য: ২০১০-২০২০
২০১০ এর পরবর্তী সময়ে বাংলা চলচ্চিত্রে একটি বৈশ্বিক পরিবর্তন দেখা যায়। বাণিজ্যিক এবং শিল্পধর্মী সিনেমার মাঝে এক ধরনের ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে। ২০১০ এর দশকে ‘প্রকাশিত’, ‘আলতাবানু’, ‘বিদেশী’, ‘পিতৃতত্ত্ব’ এসব সিনেমা বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য এক নতুন যুগের সূচনা করেছিল।
বর্তমানে বাংলা চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকারা শুধু যে বাণিজ্যিক ব্লকবাস্টার ছবির অংশ নেন, তেমন নয়। তাঁরা নির্দিষ্ট শিল্পীসত্ত্বার চিন্তা নিয়ে সমসময়ে সিনেমায় কাজ করছেন। চলচ্চিত্র নির্মাতা যেমন, শুভ্রজিৎ মিত্র, অরিন্দম শীল, রূপক দত্ত, সৃজিত মুখার্জি প্রমুখ, তাঁদের ছবির মধ্যে শিল্প, সাহিত্য, দর্শন এবং চিন্তাশীলতার গভীরতা অব্যাহত রয়েছে।
বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসের মোড় পরিবর্তনের জন্য যে সিনেমাগুলি দায়ী, সেগুলির মধ্যে ‘বাইশে শ্রাবণ’, ‘পথের পাঁচালী’, ‘সাহেব, বিবি গোলাম’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এই সিনেমাগুলির মাধ্যমে বাংলা সিনেমা বাণিজ্যিক মুনাফা নয়, বরং গভীর চিন্তা, মানবিক গল্প এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতি মনোযোগ দিয়েছে। আজকের বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পকে একটি নতুন প্রেক্ষাপটে দেখতে গেলে, এইসব সিনেমার প্রভাবকে অস্বীকার করা সম্ভব নয়।