বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাস প্রায় একশত বছরেরও পুরনো। এই দীর্ঘ সময়ে, বাংলা চলচ্চিত্র নানা পরিবর্তন এবং উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে এসেছে। তবে, একটি বিষয় যা শুরু থেকে আজ পর্যন্ত বাংলা সিনেমার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে রয়ে গেছে তা হলো—গান। সিনেমার গান বাংলা চলচ্চিত্রের অপরিহার্য অংশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে এবং সিনেমার চিত্রনাট্যের পাশাপাশি গানও দারুণভাবে সিনেমার গল্পকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।
বাংলা সিনেমার গান কেবলমাত্র বিনোদনের উপকরণ হিসেবে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি সামাজিক, সাংস্কৃতিক, এবং আবেগিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে থাকে। প্রতিটি যুগে সিনেমার গান বাংলার মানুষদের আবেগ, চিন্তা, স্বপ্ন এবং একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কের এক অমূল্য সংযোগ তৈরি করেছে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে গান ও সুরের প্রভাব অতুলনীয়—যার জ্যোতির্ময় ইতিহাস, দর্শন এবং তাৎপর্যপূর্ণ মানে রয়েছে। বাংলা সিনেমার গান শুধুমাত্র কাব্যিক নয়, এটি কখনো কখনো সমাজের সমস্যা, রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া এবং মানুষের জীবনযাত্রার প্রতিবিম্বও হয়ে ওঠে।
এই প্রবন্ধে আমরা বাংলা চলচ্চিত্রের সুর ও গানের প্রভাব এবং তার ইতিহাস, বিবর্তন এবং আধুনিক দিনের বাংলা সিনেমার গান নিয়ে আলোচনা করব।
সিনেমার গানের উত্থান: শুরুর দিক
বাংলা চলচ্চিত্রের গান প্রথমেই আসে “আলম আরা” (১৯৩১) সিনেমার মাধ্যমে, যেটি ভারতের বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম সাউন্ড ফিল্ম। এই সিনেমার গানগুলি সেরা শিল্পীদের কণ্ঠে ছিল, এবং সেই সময় থেকেই চলচ্চিত্রের গানগুলির প্রভাব দর্শকদের মধ্যে বিস্তার লাভ করে। সিনেমার গান নিয়ে আলোচনায় বলতে হয়, এই যুগে গান ছিল চলচ্চিত্রের এক অন্যতম প্রধান উপাদান—যা কেবল দর্শকদের বিনোদনই দিত না, বরং সিনেমার মূল চরিত্রের ভাবনাকে আরও গভীরভাবে ফুটিয়ে তুলত।
সিনেমার প্রথম দিকের গানগুলো মূলত রবীন্দ্রসঙ্গীত, ভাওয়াইয়া, কীর্তন এবং লোকগানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানগুলো বাংলা চলচ্চিত্রে এক বিশেষ স্থান দখল করেছিল। চলচ্চিত্রের সুরকাররা এই গানগুলিকে অনুপ্রেরণা হিসেবে নিয়ে চলচ্চিত্রে সুর সৃষ্টি করতেন। সেই সময়ের গানগুলো সাধারণত খুবই সুরেলা এবং আধ্যাত্মিক আবহ নিয়ে তৈরি করা হতো।
১৯৫০–৬০-এর দশক: গান ও সুরের স্বর্ণযুগ
১৯৫০ এবং ১৯৬০-এর দশক বাংলা চলচ্চিত্রের গান এবং সুরের জন্য একটি স্বর্ণযুগ। এই সময়ে বাংলা সিনেমায় গান সত্যিই এক অভিনব উচ্চতায় পৌঁছায়। তৎকালীন সুরকারদের সৃষ্টিতে ছিল নবীনতা, আর গানের শব্দে ছিল এক অনবদ্য মাধুর্য।
উত্তম কুমার এবং সুচিত্রা সেন এর মতো দিগগজ অভিনেতাদের যুগে, সিনেমার গানগুলোর মধ্যে রোমান্টিক এবং আবেগপূর্ণ ছোঁয়া ছিল। সুরকার সালিল চৌধুরী, সাচীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, এবং রবীন্দ্র জালাল এই যুগের অগ্রণী সুরকারদের মধ্যে অন্যতম। সালিল চৌধুরীর সুরে নির্মিত গানগুলি ছিল সত্যিকার অর্থে একটি যুগের প্রতিনিধিত্বকারী গান। সেগুলোর মধ্যে গানের লিরিক্সের পাশাপাশি সুরের পরিসরও ছিল ব্যাপক।
১৯৫৯ সালের ছবি “ক্যাবলওয়ালা” এর গান যেমন আজও মনে রেখে দেওয়া হয়, তেমনই ১৯৬০ এর দশকের পর থেকে “অগ্নিপরীক্ষা”, “মেঘে ঢাকা তারা” এবং আরও অনেক জনপ্রিয় ছবি, এর গানগুলির মাধ্যমে এই দশকটির সুর এবং গানের ঐতিহ্যকে এক নতুন আঙ্গিকে তুলে ধরেছিল।
১৯৭০-৮০-এর দশক: বিপ্লবী পরিবর্তন
১৯৭০ এবং ১৯৮০-এর দশক বাংলা সিনেমায় একটি পরিবর্তন আসতে থাকে। এই সময় চলচ্চিত্রে গানগুলোর মধ্যে নতুন ধরনের চিত্র এবং শব্দের প্রয়োগ দেখা যায়। ১৯৭০-এর দশক বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল এবং গানের মধ্যে এক ধরনের প্রতিবাদী সুর তৈরি হতে থাকে। তখনকার গানে সমাজের নানা সমস্যার প্রতিফলন ঘটছিল। “নায়ক”, “গোলাপী এখন ট্রেনে”, “আলোর মিছিল”—এই চলচ্চিত্রগুলির গানে দেখা যায় যে, গানটি একটি সামাজিক বার্তা এবং রাজনৈতিক ধারাও বহন করে।
এছাড়া, এই সময়েই কিশোর কুমার, মহম্মদ রফি, হেমন্ত কুমার এবং লতা মঙ্গেশকর সহ ভারতের বিখ্যাত গায়কদের গান বাংলা সিনেমায় আসতে থাকে। বাংলা চলচ্চিত্রে সুরকার সুধীর সেন, আনোয়ার পারভেজ, হেমন্ত কুমার এর সৃষ্ট গানগুলোর প্রভাব গভীর ছিল।
১৯৯০-এর দশক: আধুনিক গানের প্রয়োগ
৯০-এর দশকে বাংলা সিনেমায় আরেকটি বড় পরিবর্তন আসে। এই সময়ে গানের সুরে পশ্চিমি রাগের প্রভাব স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়। “ঘরে বাইরে”, “ফুল চাবি” এবং “অফিসার”—এই সিনেমাগুলির গানগুলিতে ছিল এক আধুনিক সুরের ব্যবহার, যা নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এবং শ্রেণীবদ্ধ গল্পের সঙ্গে মিলিত হয়ে সিনেমায় নতুন মাত্রা যোগ করেছিল।
এই সময়েই ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার এবং পশ্চিমি সংগীতের প্রভাব চলচ্চিত্রে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এটি বাংলা চলচ্চিত্রের গানের পরিবর্তনকে আরও সহজ করে তোলে। গানের গঠনেও বৈচিত্র্য আসে। মিউজিক্যাল ফিউশন এবং ডিজিটাল সাউন্ড এর ব্যবহারে বাংলা সিনেমার গান আরো সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে।
২০০০-এর দশক: সিনেমার গান এবং আধুনিকতা
২০০০ সালের পর বাংলা সিনেমার গানে প্রভাবিত হতে শুরু করে আধুনিক গানের ট্রেন্ড। এই সময়ে চলচ্চিত্রের গানগুলির মধ্যে এক নতুন ধরনের আধুনিক সুর দেখা যায়—যা ছিল তীব্র এবং বেশ বৈচিত্র্যময়। “দেবদাস”, “কুসুমকলি”, “বাজিমাত” ইত্যাদি চলচ্চিত্রে এক নতুন গানের স্রোত প্রবাহিত হতে থাকে। এই সময়ে গানগুলি ছিল অল্প সময়ের মধ্যে প্রচুর জনপ্রিয়তা অর্জনকারী, যেখানে লিরিক্স, সুর এবং মিউজিকাল রচনায় একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ছিল।
যেমন, “অগ্নিপথ” এবং “জীবন যন্ত্রণা” এর গানগুলির সুর, প্যাচিং, এবং গানগুলির কণ্ঠের মাধুর্য বাংলা সিনেমায় এক নতুন পরিবর্তনের সুত্রপাত করে। এতে নতুন প্রজন্মের দর্শকরা প্রবলভাবে আকৃষ্ট হয় এবং গানের নতুন সংযোজন ও কল্পনাকে স্বাগত জানায়।
বাংলা সিনেমার গান ও সমাজের প্রতিফলন
বাংলা চলচ্চিত্রের গান কেবলমাত্র বিনোদনমূলক উপাদান নয়, বরং এটি সমাজের পরিবর্তনশীল চিত্রও তুলে ধরেছে। বাংলা সিনেমার গানগুলি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের, প্রেম, বিরহ, সংগ্রাম এবং আশা-নিরাশার বিষয়গুলির প্রতিফলন। গান ছিল প্রতিটি স্তরের মানুষের জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা সামাজিক অবস্থা এবং জীবনযাত্রার প্রতিফলন ছিল। উদাহরণস্বরূপ, “আমরা যদি বসন্তের হাওয়ায়” এবং “মাগো মা আমার মায়ের” এর মতো গানগুলি যে শুধু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা প্রকাশ করে না, বরং সে সময়কার সামাজিক অবস্থা এবং জনগণের কষ্টের কথা তুলে ধরে, তা স্পষ্ট।
বাংলা চলচ্চিত্রের গান যুগে যুগে বিভিন্ন পরিবর্তন ও প্রভাবের মধ্যে দিয়ে চলেছে। গানের সুর, শব্দ এবং পরিবেশনা বাংলা চলচ্চিত্রের ধারাকে যেমন সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি এটি একটি নির্দিষ্ট সময়ের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটকেও চিত্রিত করেছে। আজকের আধুনিক ডিজিটাল যুগে যখন চলচ্চিত্রের গান ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সমাদৃত, তখনও বাংলা সিনেমার গান তার ঐতিহ্য এবং রূপায়নের বিশেষত্ব বজায় রেখেছে।
বাংলা চলচ্চিত্রের গান তার সৃষ্টির ইতিহাসে এক শক্তিশালী এবং অবিচ্ছেদ্য উপাদান হয়ে উঠেছে। এটি শুধু যে বিনোদন দেয়, তা নয়—এটি মানুষের আবেগ, চিন্তা, এবং অনুভূতির এক অমূল্য অংশ হয়ে থেকেছে। সিনেমার গানের রূপ ও রস আজও বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম অমূল্য ঐতিহ্য হয়ে থাকবে।