• June 23, 2025

Chalachchitra

Explore the magic of Bengali cinema and culture

ফলস ফিল্ম বনাম বাস্তব চলচ্চিত্র: সাম্প্রতিক বাংলা সিনেমার ট্রেন্ডস

ByDidarul Islam Himel

Nov 9, 2024

বাংলা সিনেমার ইতিহাস এক দীর্ঘ ও বৈচিত্র্যময় যাত্রা। চলচ্চিত্রের প্রথম দিক থেকে আজ পর্যন্ত অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। সত্তরের দশক থেকে বাংলা সিনেমার যে সোনালি যুগ শুরু হয়েছিল, তা একদিকে যেমন ছিল সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের পরিচায়ক, তেমনি ছিল শিল্পের নিখুঁত প্রয়োগের ফল। সেসব সিনেমায় সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়গুলি গভীরভাবে প্রতিফলিত হত, এবং দর্শকরা শুধুমাত্র বিনোদনই পেতেন না, বরং ভাবনার জন্যও কিছু পেতেন।

কিন্তু গত কয়েক দশকে বাংলা সিনেমায় একটি নতুন ধরনের প্রবণতা দেখা দিয়েছে। একদিকে যেমন বাণিজ্যিক সিনেমা, বা ‘ফলস ফিল্ম’ (Escapist Films), অন্যদিকে বাস্তব জীবন এবং সমাজের সঙ্গে সম্পর্কিত গভীর চিন্তা-ভাবনা প্রকাশিত হতে থাকা বাস্তব চলচ্চিত্রের (Realistic Cinema) সংখ্যা বাড়ছে। এই দুই ধারার মধ্যে কোনো একটি ছবির শ্রেষ্ঠতা নির্ধারণ করা সত্যিই কঠিন, তবে সেগুলির মধ্যে যে দারুণ পার্থক্য রয়েছে, তা স্পষ্ট।

আজকের এই নিবন্ধে আমরা দুটি ভিন্ন ধারার বাংলা সিনেমা, অর্থাৎ ফলস ফিল্ম এবং বাস্তব চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনা করব। এছাড়া সাম্প্রতিক বাংলা সিনেমার নতুন ট্রেন্ডগুলিও বিশ্লেষণ করব।

১. ফলস ফিল্ম কী?

ফলস ফিল্ম বা ‘Escapist Cinema’ শব্দটি এমন ধরনের চলচ্চিত্রকে বোঝায় যা দর্শকদের বাস্তবতা থেকে বিরত রাখে এবং তাদের এমন একটি জগতের মধ্যে নিয়ে যায় যেখানে সব কিছু আদর্শ এবং বাস্তব থেকে আলাদা। এই ধরনের সিনেমায় দর্শক সাধারণত জীবনের কঠিন বাস্তবতা, দুঃখ, সংগ্রাম, সামাজিক সমস্যা, রাজনীতি বা অর্থনৈতিক সংকট থেকে পালিয়ে যেতে চান। ফলস ফিল্মের মূল উদ্দেশ্য হলো দর্শককে সস্তা এবং সোজা উপায়ে বিনোদন প্রদান করা, যেখানে রোমাঞ্চ, প্রেম, অ্যাকশন, এবং সহজ সমাধানগুলো প্রাধান্য পায়।

এই ধরনের সিনেমা সাধারণত:

  • একাধিক সুপারহিরো চরিত্র বা অতিমানবীয় গুণাবলী প্রদর্শন করে।
  • গল্পের মধ্যে অতিরিক্ত নাটকীয়তা, সুরকারণ, অতি নাটকীয় রোমান্স বা অতিরিক্ত অঙ্গভঙ্গি থাকে।
  • সামাজিক বা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সীমিত থাকে, যেখানে বেশি প্রাধান্য পায় দর্শকের বিনোদন এবং উত্তেজনা।
  • সাধারণত থ্রিলার, অ্যাকশন, রোমান্স অথবা ফ্যান্টাসি নিয়ে গঠিত হয়।

বাংলা সিনেমায় এই ধরনের সিনেমাগুলি অনেকাংশে সত্তরের দশক থেকে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। যেমন, মিঠুন চক্রবর্তী এবং উত্তম কুমারের অ্যাকশন সিনেমাগুলি ছিল সেই সময়কার জনপ্রিয় ফলস ফিল্ম।

২. বাস্তব চলচ্চিত্র কী?

অন্যদিকে, বাস্তব চলচ্চিত্র বা Realistic Cinema হল এমন ধরনের সিনেমা যা প্রকৃত জীবন এবং সমাজের সমস্যাগুলিকে মূল বিষয় হিসেবে নেয়। এই ধরনের সিনেমাগুলো দৃষ্টিভঙ্গি ও কাহিনীতে সরল, কিন্তু গভীর ও বাস্তবধর্মী। বাস্তব চলচ্চিত্রে মানুষ, সমাজ, পরিবার, সম্পর্ক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যা, দেশীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং পরিবেশগত সংকট প্রাধান্য পায়। এই সিনেমাগুলির উদ্দেশ্য হল দর্শকদের জীবনের প্রকৃত চিত্র দেখানো এবং সমাজের নানান সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা।

বাস্তব চলচ্চিত্রের বৈশিষ্ট্য:

  • সমাজের নানা স্তরের বাস্তব চিত্র তুলে ধরা।
  • নাটকীয়তার চাইতে চরিত্রগুলির মনস্তত্ত্ব, আবেগ, এবং তাদের সম্পর্কের দিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া।
  • সিনেমার কাহিনীতে বিশেষ কোন সুরেলা বা ফ্যান্টাসি উপাদান নেই।
  • সমাজ, রাষ্ট্র, অথবা আদর্শের সমালোচনা করা হয়ে থাকে।

উদাহরণস্বরূপ, সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী, ঋত্বিক ঘটকের মেঘে ঢাকা তারা কিংবা মৃণাল সেনের ভুবন সোম – এ ধরনের সিনেমা প্রকৃতির দিক থেকে বাস্তব চলচ্চিত্রের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এসব চলচ্চিত্র শুধু বিনোদন নয়, তারা আমাদের সামাজিক সমস্যা, মানুষের দুঃখ-সুখ এবং তাদের লড়াইকে তুলে ধরেছিল।

৩. বাংলা সিনেমার বর্তমান ট্রেন্ডস

বিগত কয়েক বছরে বাংলা সিনেমায় অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। নতুন প্রজন্মের নির্মাতারা আধুনিক চিন্তা ও প্রযুক্তির মিশেলে নতুন ধরনের গল্প নিয়ে সিনেমা নির্মাণ করছেন। এই সময়ের সিনেমায় ফলস ফিল্ম এবং বাস্তব চলচ্চিত্র এর মধ্যে এক ধরনের সমন্বয় দেখা যাচ্ছে, যেখানে কিছু সিনেমা দর্শকদের বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে চাইলেও একটি নির্দিষ্ট বিনোদনের উপাদানও বজায় রাখছে। আবার কিছু সিনেমা পুরোপুরি বাস্তববাদী।

৩.১. কমার্শিয়াল সিনেমার উত্থান

বর্তমানে বাংলা সিনেমায় কমার্শিয়াল সিনেমার প্রতি দর্শকদের আগ্রহ বেড়েছে। তবে এখানে শুধু অ্যাকশন বা রোমান্স ভিত্তিক সিনেমা নয়, বরং কিছু সিনেমা সামাজিক বিষয়গুলিকে প্রচুর বিনোদন এবং বাণিজ্যিক উপাদান দিয়ে পরিবেশন করছে। যেমন, “দৃষ্টিকোণ” (২০১৮), “গোলন্দাজ” (২০২1), এবং “ক্রিসক্রস” (২০২০) এর মতো সিনেমাগুলি প্রকৃত ঘটনা বা বাস্তব জীবনের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত, কিন্তু তারা এক্সট্রা নাটকীয়তা, কমেডি এবং উচ্চমানের টেকনিক্যাল উপাদান দিয়ে দর্শকদের মনোরঞ্জন করার চেষ্টা করেছে।

৩.২. বাস্তবের কাছে ফিরে আসা

আধুনিক বাংলা সিনেমায় গত কয়েক বছরে একটি প্রবণতা দেখা যাচ্ছে—বাস্তব চিন্তা এবং সমাজের বাস্তব চিত্র আরও বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। পরিচালকরা এখন বাস্তব সমাজ এবং মানুষের জীবনযাত্রা নিয়ে গল্প তৈরি করছেন। এর উদাহরণ হিসেবে “ভিঞ্চি দা” (২০১৭), “বাবা বেবি ও” (২০১৯), “রোজ অ্যান্ড দ্য সিটি” (২০২০) এবং “অভিযান” (২০২১) এর মতো সিনেমা লক্ষ্য করা যায়। এসব সিনেমা সামাজিক, রাজনৈতিক, বা অর্থনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলে ধরে, তবে এগুলোর বিনোদনমূলক চরিত্রও রয়েছে।

৩.৩. স্বল্প বাজেট এবং ইনডিপেনডেন্ট সিনেমার বিকাশ

বর্তমানে বাংলা চলচ্চিত্রের আরও একটি বড় পরিবর্তন হল স্বল্প বাজেট এবং ইনডিপেনডেন্ট সিনেমা। স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতারা এখন নতুন ধারণা এবং কাহিনী নিয়ে কাজ করছেন, এবং তাদের সিনেমাগুলো বাণিজ্যিক প্রবণতা থেকে দূরে থেকেও বিশেষ শ্রেণির দর্শকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করছে। উদাহরণস্বরূপ, “কল্পনাওয়ালা” (২০২০), “অর্পণ” (২০২৩) এর মতো সিনেমাগুলি মূলত সমাজের গভীর সমস্যাগুলি এবং সম্পর্কের জটিলতাকে বাস্তবতার সাথে মেলানোভাবে দেখাচ্ছে।

৩.৪. পুরনো সিনেমার রিমেক এবং রিবুট

ফলস ফিল্মের এক ট্রেন্ড হল পুরনো সিনেমাগুলির রিমেক করা। অনেক পরিচালক এখন ক্লাসিক বাংলা সিনেমাগুলির আধুনিক সংস্করণ তৈরি করছেন। উদাহরণস্বরূপ, “ডাকঘর” (২০১৯), “চিরদিনই তুমি যে আমার” (২০২০) বা “প্রতিদ্বন্দ্বী” (২০২২) এর মতো সিনেমাগুলি জনপ্রিয় পুরনো সিনেমাগুলির নতুন রূপ। তবে, এ ধরনের সিনেমা নির্মাণের সময় কিছু নির্মাতারা আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে নতুন ধারার বিনোদনমূলক উপাদান সংযোজন করে থাকেন।

৪. ফলস ফিল্ম বনাম বাস্তব চলচ্চিত্র: বাংলার দর্শক কোথায়?

বাংলা সিনেমার বাজারে এই দুই ধরণের সিনেমা—ফলস ফিল্ম এবং বাস্তব চলচ্চিত্র—দ্বারা দর্শকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। তবে, সাম্প্রতিক বাংলা সিনেমার প্রসারে সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি উঠে আসছে তা হলো ধারণা এবং দর্শকের পছন্দের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা

ফলস ফিল্ম দর্শকরা সাধারণত তাদের দৈনন্দিন জীবন থেকে কিছুটা বিরতি নিতে চান। তারা সিনেমায় এমন কিছু খুঁজছেন যা তাদের ভাবনার বাইরে, যেখানে সমস্যা নেই, বা যেখানে তারা সুখী সমাধান পায়। তারা রোমান্স, অ্যাকশন, হাস্যরসের জন্য সিনেমা দেখতে চান।

অন্যদিকে, বাস্তব চলচ্চিত্র প্রেমিক দর্শকরা সাধারণত সমাজের গভীর প্রশ্ন ও চরিত্রগুলির মধ্য দিয়ে সমাজের বিভিন্ন অবস্থান, অনুভূতি ও সম্পর্কের সাথে সম্পর্কিত হতে চান। তারা সিনেমায় জীবনের বাস্তব চিত্র দেখতে চান, যেখানে নিখুঁত সমাধান নয়, বরং একটি অপ্রত্যাশিত বা অস্বস্তিকর শেষ থাকে।

বাংলা সিনেমায় দুটো প্রবণতার মিলনের দিকে বর্তমান প্রজন্মের নির্মাতারা হাঁটছেন। সমসাময়িক বাংলা সিনেমায় ফলস ফিল্ম এর উপাদান এবং বাস্তব চিন্তা মিশ্রিত হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *