• July 5, 2025

Chalachchitra

Explore the magic of Bengali cinema and culture

ক্লাইমেট চেঞ্জ এবং বাংলাদেশ: কীভাবে আমরা টিকে থাকতে পারি

ByDidarul Islam Himel

Nov 9, 2024

আজকের পৃথিবী একটি গুরুতর সংকটের সম্মুখীন। ক্রমবর্ধমান জলবায়ু পরিবর্তন বা “ক্লাইমেট চেঞ্জ” একে একে আমাদের পরিবেশ, জীবনযাত্রা এবং দেশের অর্থনীতিতে বিরাট প্রভাব ফেলছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ, যা তার ভূ-গঠন, নদীপ্রবাহ এবং উপকূলবর্তী অবস্থানের কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম, সেখানে এর প্রভাব অত্যন্ত তীব্র। দেশটির বিপুল জনসংখ্যা, দারিদ্র্য, এবং অপর্যাপ্ত অবকাঠামো এই চ্যালেঞ্জগুলোর মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ক্লাইমেট চেঞ্জের কারণে বাংলাদেশে যে বড় ধরনের পরিবর্তনগুলো ঘটতে পারে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, উপকূলীয় এলাকা ডুবে যাওয়া, কৃষিক্ষেত্রে ক্ষতি, স্বাস্থ্যঝুঁকি বৃদ্ধি, পানি সংকট ইত্যাদি। এসব পরিবর্তন দেশের মানুষের জীবনধারা, খাদ্য নিরাপত্তা, জীবিকা, এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা সংকটাপন্ন করে তুলতে পারে।

এতদূর আলোচনার পর, আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো: “বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা করতে আমাদের কীভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে, এবং কীভাবে আমরা এই সংকটের মধ্যেও টিকে থাকতে পারব?”

এই প্রবন্ধে আমরা ক্লাইমেট চেঞ্জের প্রভাব, বাংলাদেশে এর বর্তমান পরিস্থিতি, এবং আমাদের প্রতিরোধ, অভিযোজন, এবং নিরপেক্ষতা কৌশলগুলো আলোচনা করবো।

জলবায়ু পরিবর্তনের ধারণা

জলবায়ু পরিবর্তন বা ক্লাইমেট চেঞ্জ বলতে বোঝানো হয় পৃথিবীর জলবায়ু সিস্টেমে দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তনকে। এটি সাধারনত মানবসৃষ্ট কার্যক্রমের ফলে ঘটে থাকে, যেমন বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন, এবং অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ। গ্রীনহাউস গ্যাসগুলি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে তাপ ধরে রাখে, যা পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং আবহাওয়া প্যাটার্নে পরিবর্তন ঘটায়।

এই পরিবর্তনের প্রভাব বিভিন্ন অঞ্চলে আলাদা হতে পারে, তবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো, বিশেষ করে বাংলাদেশ, অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তনশীলতা দেশগুলোর কৃষি, জনস্বাস্থ্য, জলসম্পদ এবং জীবনযাত্রার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।

বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান এবং ঝুঁকি

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি উপকূলীয় দেশ, যা গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা নদী অববাহিকায় অবস্থিত। দেশটির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য যেমন নিম্নভূমি, উপকূলীয় এলাকা, এবং অতিরিক্ত নদীপ্রবাহ বাংলাদেশকে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ প্রতি বছর প্রায় ১০ মিলিয়ন টন কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ করে, তবে এই নিঃসরণ কতটা বাংলাদেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে তা তার ভূ-গাঠনিক অবস্থান ও আবহাওয়ার পরিবর্তনের ওপর নির্ভর করে।

উপকূলীয় এলাকা ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উত্থান

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় ৩০টি জেলা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কম উচ্চতায় অবস্থিত, এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উত্থান (যার ফলে ভূমি পানির নিচে চলে যাবে) তাদের জন্য একটি বড় ধরনের আশঙ্কা। বিজ্ঞানীরা পূর্বাভাস দিয়েছেন যে, আগামী কয়েক দশকে সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় উচ্চতা প্রায় এক মিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে, যা বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের বিশাল অংশ পানির নিচে চলে যেতে পারে।

এছাড়া, উপকূলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা এবং ঘনত্বও বাড়ছে, যার কারণে এই অঞ্চলের মানুষদের জীবিকা বিপন্ন হচ্ছে।

বন্যা এবং নদীভাঙন

বাংলাদেশের বেশিরভাগ অঞ্চল নদী দ্বারা পরিবেষ্টিত, এবং এ কারণে বর্ষাকালে ব্যাপক বন্যা হওয়ার প্রবণতা রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে তুষারপাত এবং বরফ গলনের মাত্রা বাড়ছে, যার ফলে নদীগুলোর পানির স্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বন্যার ঝুঁকি বাড়ছে। বন্যার ফলে ফসলের ক্ষতি, গৃহহীন হওয়া, এবং মানুষের জীবনযাত্রায় বিপর্যয় ঘটতে পারে।

এছাড়া, নদীভাঙন এবং জমি হারানো বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সমস্যা। প্রতি বছর নদীভাঙনে হাজার হাজার একর জমি বিলীন হয়ে যায়, ফলে কৃষি উৎপাদনেও প্রভাব পড়ছে।

কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা

বাংলাদেশের কৃষি খাত বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি, এবং এটি জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম বড় শিকার। বার্ষিক বন্যা, দীর্ঘমেয়াদী খরা, অস্বাভাবিক তাপমাত্রা, এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ কৃষির উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে, মৌসুমী ফসলের উৎপাদন ও সুরক্ষা আশঙ্কাজনকভাবে কমে যেতে পারে। ধান, গম, ও সবজি উৎপাদন হ্রাস পেতে পারে, যার ফলে খাদ্য নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।

বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দৃশ্যমানভাবে অনুভূত হতে শুরু করেছে। কিছু উল্লেখযোগ্য প্রভাবের মধ্যে:

১. ঘূর্ণিঝড় এবং বৃষ্টিপাতের পরিবর্তন

প্রতি বছর বাংলাদেশে বেশ কিছু ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে, যার মধ্যে অন্যতম হলো “আম্পান”, “বুলবুল” এবং “ইয়াস” এর মতো বিধ্বংসী ঝড়। এসব ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ব্যাপক ভাঙন, বন্যা, খাদ্য নিরাপত্তার সংকট এবং মানুষজনের ঘর-বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

অতিবৃষ্টি এবং অস্বাভাবিক তাপমাত্রা কৃষির উৎপাদনে বিশাল প্রভাব ফেলছে। নানান সময়ে মৌসুমী বৃষ্টিপাতের শর্ত পরিবর্তনও দেখা যাচ্ছে।

২. জলসংকট এবং পানির মান

জলবায়ু পরিবর্তন সরাসরি বাংলাদেশের জলসম্পদ ব্যবস্থাপনার ওপর প্রভাব ফেলছে। নদী এবং জলাশয়গুলোর পানি স্তরের পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে পানির প্রবাহে ব্যাঘাত ঘটছে, যার ফলে পানি সংকট তৈরি হচ্ছে। দেশটির উত্তরাঞ্চলে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে এবং বেশ কিছু অঞ্চলে পানির মানও কমছে। কৃষি, স্বাস্থ্য এবং জীবিকা ঝুঁকির মুখে পড়ছে।

৩. স্বাস্থ্যঝুঁকি

জলবায়ু পরিবর্তন বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে স্যানিটেশন সমস্যা, দূষিত পানি, খাদ্য নিরাপত্তার অভাব এবং বন্যার কারণে জীবাণু সংক্রমণ বৃদ্ধি পেতে পারে। এছাড়া, গরমের সময় তাপমাত্রা বৃদ্ধি হলে তাপজনিত রোগও বেড়ে যেতে পারে।

৪. মানুষের জীবিকা ও অভিবাসন

ক্লাইমেট চেঞ্জের কারণে হাজার হাজার মানুষ তাদের বাড়ি থেকে উৎখাত হতে পারে। উপকূলীয় অঞ্চলের বাসিন্দাদের পাড়ি জমাতে হতে পারে অন্যত্র, যার ফলে অভ্যন্তরীণ অভিবাসন বাড়বে এবং জনগণের জীবিকা বিপন্ন হবে। কৃষি, মৎস্য, এবং অন্যান্য আঞ্চলিক ব্যবসা বিপর্যস্ত হলে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

ক্লাইমেট চেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশে কিভাবে টিকে থাকা সম্ভব?

ক্লাইমেট চেঞ্জের মোকাবেলা ও অভিযোজনের জন্য বাংলাদেশকে কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এসব পদক্ষেপ শুধুমাত্র বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও মানবাধিকার রক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং বিশ্বের অন্যান্য দেশও বাংলাদেশের ক্লাইমেট চেঞ্জ মোকাবেলার অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতে পারে।

১. অবকাঠামো উন্নয়ন এবং উপকূলীয় সুরক্ষা

বাংলাদেশে নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড়, এবং বন্যার ক্ষতি প্রতিরোধে উপকূলীয় সুরক্ষা এবং অবকাঠামো উন্নয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাঁধ, খাল, ডাইক, ও জলাধারের মতো সুরক্ষা প্রকল্পগুলো কার্যকরভাবে নির্মাণ এবং রক্ষণাবেক্ষণ করা উচিত। স্থানীয় জনগণকে সচেতন করা এবং তাদেরকে দুর্যোগকালীন সময়ে প্রস্তুতির জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত।

২. জলসম্পদ ব্যবস্থাপনা

জলসংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশে একটি সমন্বিত জলসম্পদ ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। নদী এবং অন্যান্য জলাশয়ের পানি ব্যবহারের পরিকল্পনা, পুনর্ব্যবহারযোগ্য পানি ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি, এবং বর্ষার সময় পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থার উন্নয়ন করা উচিত।

৩. কৃষির অভিযোজন

বাংলাদেশে কৃষি খাতের অভিযোজন কৌশল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কৃষকদের জন্য আবহাওয়ার পূর্বাভাস সেবা, সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন, এবং অপ্রচলিত ফসলের উৎপাদন কৌশলকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এছাড়া, কৃষকদের জলবায়ু সহিষ্ণু প্রযুক্তি ব্যবহার এবং দুর্যোগ সহিষ্ণু প্রজাতি উৎপাদনে উৎসাহিত করা উচিত।

৪. স্বাস্থ্য এবং সমাজকল্যাণ ব্যবস্থা

বাংলাদেশে স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবেলায় ক্লাইমেট চেঞ্জ সম্পর্কিত স্বাস্থ্যসেবা নেটওয়ার্কের উন্নয়ন, তাপমাত্রার কারণে রোগপ্রতিরোধ, এবং স্বাস্থ্য সচেতনতা কার্যক্রম গ্রহণ করা উচিত। এমনকি, কমিউনিটি-ভিত্তিক উদ্যোগ এবং দুর্যোগকালীন সময়ে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি।

৫. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং নীতিনির্ধারণ

বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক দৃঢ় করা উচিত, যা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় গবেষণা, প্রযুক্তি স্থানান্তর, এবং অভিজ্ঞতা শেয়ারিংয়ে সহায়ক হতে পারে। উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে জলবায়ু তহবিল প্রাপ্তি এবং আন্তর্জাতিক জলবায়ু চুক্তি অনুসরণ করা উচিত।

বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত এবং এর মোকাবেলা একটি অত্যন্ত জরুরি ও সময়োপযোগী বিষয়। যদিও বাংলাদেশ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ দেশ, তবে যথাযথ প্রস্তুতি, অভিযোজন এবং সহযোগিতার মাধ্যমে আমরা এ সংকট মোকাবেলা করতে সক্ষম। আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ এবং সুরক্ষিত পৃথিবী নির্মাণের জন্য একযোগে কাজ করতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *