• June 7, 2025

Chalachchitra

Explore the magic of Bengali cinema and culture

স্মার্ট সিটি: বাংলাদেশের শহরগুলির ভবিষ্যত

বিশ্বব্যাপী দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রযুক্তির যুগে, শহরগুলো এখন আর কেবল মানুষের বসবাসের স্থান নয়, তারা আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ও পরিবেশগত নানা স্তরের উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এখন স্মার্ট সিটি গঠনের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। স্মার্ট সিটি ধারণার মূল উদ্দেশ্য হলো শহরগুলোকে এমনভাবে ডিজাইন করা, যা টেকসই উন্নয়ন, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত করার মাধ্যমে নাগরিকদের সেবা প্রদান করবে। বাংলাদেশও তার শহরগুলির উন্নয়ন নিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলেও স্মার্ট সিটি গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে।

এ নিবন্ধে আমরা স্মার্ট সিটি ধারণা, এর বিভিন্ন উপাদান, বাংলাদেশের শহরগুলির বর্তমান চিত্র এবং ভবিষ্যত সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

### ১. স্মার্ট সিটি: ধারণা ও সংজ্ঞা

স্মার্ট সিটি বলতে বোঝানো হয় এমন একটি শহর, যেখানে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (ICT) এবং অন্যান্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে শহরের বিভিন্ন সেবা ও কার্যক্রম সহজতর করা হয়। এটি সাধারণত শহরের অবকাঠামো, পরিবহন ব্যবস্থা, শক্তি ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপত্তা এবং অন্যান্য নাগরিক সেবার মধ্যে স্মার্ট প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বাসযোগ্য, নিরাপদ ও টেকসই পরিবেশ সৃষ্টি করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে।

স্মার্ট সিটি বলতে শুধুমাত্র প্রযুক্তির ব্যবহার নয়, এর মধ্যে রয়েছে নগর পরিকল্পনা, পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন, সাশ্রয়ী শক্তি ব্যবহার, পানি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, স্মার্ট ট্রান্সপোর্টেশন সিস্টেম, নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং নাগরিকদের জন্য কার্যকর সেবা প্রদান করার মতো বিষয়গুলো।

### ২. স্মার্ট সিটির উপাদান

স্মার্ট সিটি গঠনে বিভিন্ন উপাদান বা সিস্টেমকে একত্রিত করা প্রয়োজন। এই উপাদানগুলো শহরের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করতে সহায়তা করে। নিম্নে স্মার্ট সিটির প্রধান উপাদানগুলোর আলোচনা করা হলো:

#### ২.১. তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (ICT)

ICT বা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি স্মার্ট সিটির মেরুদণ্ড। এটি শহরের বিভিন্ন কার্যক্রমকে সহজতর করে এবং দ্রুততর সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সহায়ক হয়। স্মার্ট সিটিতে উন্নত তথ্য নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেট অফ থিংস (IoT), ডেটা অ্যানালিটিক্স, এবং ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের মাধ্যমে শহরের সবকিছু পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, স্মার্ট সিটির ট্রাফিক সিস্টেম, বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা, পানি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সিস্টেমগুলো তথ্য প্রযুক্তির সাহায্যে আরও কার্যকরী হয়ে ওঠে।

#### ২.২. স্মার্ট পরিবহন ব্যবস্থা

স্মার্ট সিটিতে পরিবহন ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। স্মার্ট পরিবহন ব্যবস্থা শুধুমাত্র দ্রুত এবং নিরাপদ যাতায়াতের ব্যবস্থা তৈরি করে না, এটি পরিবেশ বান্ধবও হয়। স্মার্ট ট্রাফিক সিগনাল, রিয়েল-টাইম ট্রাফিক ইনফরমেশন, ইলেকট্রিক ভেহিকল (EV) চার্জিং স্টেশন, সাইকেল শেয়ারিং প্রোগ্রাম, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম উন্নত করে স্মার্ট সিটি নাগরিকদের জন্য সুবিধাজনক পরিবহন ব্যবস্থা প্রদান করে।

#### ২.৩. টেকসই শক্তি ব্যবস্থাপনা

স্মার্ট সিটির জন্য টেকসই শক্তি ব্যবস্থাপনা অপরিহার্য। সৌরশক্তি, বায়োএনার্জি, জলবিদ্যুৎ এবং অন্যান্য নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার স্মার্ট সিটির শক্তির চাহিদা মেটাতে সাহায্য করে। স্মার্ট গ্রিড এবং স্মার্ট মিটারিং প্রযুক্তির মাধ্যমে শক্তি ব্যবহারের নজরদারি এবং অপচয় কমানো যায়।

#### ২.৪. সুশাসন ও নাগরিক সেবা

স্মার্ট সিটির আরেকটি প্রধান দিক হলো সুশাসন ও নাগরিক সেবা। এখানে নাগরিকদের সেবা প্রদান সহজতর করার জন্য ই-গভর্নেন্স, অনলাইন পোর্টাল, ডিজিটাল সার্ভিস এবং মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহৃত হয়। এতে নাগরিকরা সহজে সরকারি সেবা পেতে পারে এবং স্থানীয় সরকার নিজেদের কার্যক্রম আরও স্বচ্ছভাবে পরিচালনা করতে পারে।

#### ২.৫. নিরাপত্তা ও নজরদারি

স্মার্ট সিটিতে নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে সিসিটিভি ক্যামেরা, ড্রোন, ফেস রিকগনিশন এবং অন্যান্য উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে শহরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। এছাড়া, স্মার্ট পুলিশিং সিস্টেমের মাধ্যমে অপরাধের পূর্বাভাস পাওয়া এবং দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হয়।

### ৩. বাংলাদেশের বর্তমান শহরগুলির চিত্র

বাংলাদেশের শহরগুলো বর্তমানে নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। দেশের জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, শহরগুলোর ওপর চাপ বাড়ছে, এবং অবকাঠামো ও সেবা ব্যবস্থার মান উন্নত করার জন্য প্রচুর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেটসহ দেশের বড় শহরগুলোর মধ্যে দ্রুত নগরায়ণের প্রক্রিয়া চলছে।

তবে এই নগরগুলোতে এখনো নানা সমস্যা বিদ্যমান:

– **ট্রাফিক সমস্যা**: ঢাকা শহরের একাধিক জায়গায় যানজট একটি দৈনন্দিন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যাতায়াত ব্যবস্থা অত্যন্ত অপ্রতুল এবং অব্যবস্থাপনা রয়েছে।

– **পরিবেশ দূষণ**: শহরের বায়ু দূষণ, পানি দূষণ এবং শব্দ দূষণ মারাত্মকভাবে বেড়েছে।

– **বিদ্যুৎ ও পানির সরবরাহ**: শহরের দ্রুত বৃদ্ধির ফলে বিদ্যুৎ ও পানির সরবরাহ ব্যবস্থাও অনেক সময় দুর্বল হয়ে পড়ে।

– **বর্জ্য ব্যবস্থাপনা**: শহরে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সঠিকভাবে বর্জ্য পুনর্ব্যবহার এবং নিষ্কাশন করা সম্ভব হচ্ছেনা।

### ৪. স্মার্ট সিটির বাস্তবায়ন: বাংলাদেশে সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশে স্মার্ট সিটি বাস্তবায়নের জন্য সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ রয়েছে। ঢাকা শহরের পুরান ঢাকার একটি অংশে স্মার্ট সিটি নির্মাণের জন্য ইতোমধ্যে পরিকল্পনা শুরু হয়েছে। এছাড়া, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী এবং সিলেটসহ অন্যান্য শহরে স্মার্ট সিটির ধারণা বাস্তবায়নে কাজ চলছে।

#### ৪.১. সরকারী উদ্যোগ

বাংলাদেশ সরকার ২০১৫ সালে “স্মার্ট সিটি” নির্মাণের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করে। বিভিন্ন প্রকল্পে প্রাথমিকভাবে তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়ন, স্মার্ট সিটি অবকাঠামো, পরিবহন ব্যবস্থা উন্নত করা এবং সাশ্রয়ী শক্তি ব্যবস্থাপনার দিকে মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে ঢাকা শহরের মধ্যে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে নাগরিক সেবা উন্নত করার জন্য নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

#### ৪.২. প্রযুক্তির ভূমিকা

টেকসই উন্নয়ন এবং স্মার্ট সিটি গঠনে প্রযুক্তি এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ৫জি নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেট অফ থিংস (IoT), বিগ ডেটা, এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) শহরের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ এবং সেবা প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। এছাড়া, বাংলাদেশে মোবাইল ফিনান্সিয়াল সিস্টেম (MFS) যেমন বিকাশ, নগদ, এবং রকেট শহরের মানুষের জন্য সহজে আর্থিক সেবা নিশ্চিত করেছে।

#### ৪.৩. নাগরিক সচেতনতা এবং অংশগ্রহণ

স্মার্ট সিটির সফল বাস্তবায়নে নাগরিকদের সচেতনতা এবং অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নাগরিকদের সম্মতি ও সহযোগিতা ছাড়া স্মার্ট সিটি গঠন সম্ভব নয়। এজন্য নাগরিকদের প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

#### ৪.৪. চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশে স্মার্ট সিটি বাস্তবায়নের পথে কিছু বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে:

– **অর্থনৈতিক সমস্যা**: স্মার্ট সিটি গঠনের জন্য বিশাল আর্থিক বিনিয়োগ প্রয়োজন, যা সরকারি ও বেসরকারি খাতের যৌথ সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব নয়।

– **প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও দক্ষতা**: দেশের সাধারণ জনগণ ও কর্মকর্তাদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও জ্ঞানের অভাব রয়েছে। এজন্য প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণের প্রয়োজন।

– **পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ**: বাংলাদেশের শহরগুলোতে যে পরিবেশগত সমস্যা রয়েছে, তা মোকাবিলা করতে স্মার্ট স

িটির উন্নয়ন কঠিন হতে পারে।

### ৫. উপসংহার

স্মার্ট সিটি বাংলাদেশের শহরগুলির ভবিষ্যত হতে পারে, তবে এর জন্য ব্যাপক পরিকল্পনা, বিনিয়োগ এবং প্রযুক্তির ব্যবহার প্রয়োজন। বাংলাদেশের শহরগুলোতে স্মার্ট সিটি গঠন করার মাধ্যমে নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি করা সম্ভব, সেই সঙ্গে পরিবেশ সুরক্ষা এবং টেকসই উন্নয়নও নিশ্চিত করা যেতে পারে। স্মার্ট সিটি বাস্তবায়ন শুধুমাত্র প্রযুক্তি নয়, এটি সমাজ, অর্থনীতি, পরিবেশ এবং প্রশাসনিক কার্যক্রমের সম্মিলিত একটি প্রক্রিয়া। স্মার্ট সিটির মাধ্যমে বাংলাদেশের শহরগুলো আধুনিক, নিরাপদ এবং উন্নত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *