• June 28, 2025

Chalachchitra

Explore the magic of Bengali cinema and culture

দ্য টেল অফ গেঞ্জিঃ পৃথিবীর প্রথম উপন্যাস

ByDidarul Islam Himel

Jan 9, 2024

গল্প উপন্যাস পড়তে আমরা কমবেশি সবাই ভালোবাসি। আমাদের বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস প্যারীচাঁদ মিত্রের লেখা ‘আলালের ঘরের দুলাল’। সেটি ১৮৫৮ সালে লিখেছিলেন তিনি। আজ থেকে প্রায় ১৬৩ বছর আগে!
অথচ বিশ্বের প্রথম উপন্যাস লেখা হয়েছিল আজ থেকে ১০১২ বছর আগে জাপানি ভাষায়। আর সেই উপন্যাস লিখেছিলেন একজন নারী, ভাবা যায়?

আজ থেকে প্রায় হাজার বছর আগে ১০০৭ সালে প্রথম পূর্ণাঙ্গ একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থটিতে চরিত্র ছিল মোট ৩৫০টি আর ছিল অসংখ্য আবেগময় কবিতা। ‘দ্য টেল অফ গেঞ্জি’ নামে এ উপন্যাসটিতে এক রাজপুত্রের ভালোবাসার কাহিনী বিধৃত হয়েছে; এ রাজপুত্র অসংখ্য নারীর সঙ্গ পছন্দ করতেন। উপন্যাসটি রচনা করেছিলেন জাপানের নারী ঔপন্যাসিক মুরাসাকি শিকিবু। এটিই বিশ্বের প্রথম উপন্যাস।

মুরাসাকি শিকিবু

৯৭৮ (মতান্তরে ৯৭৩) খ্রিষ্টাব্দে জাপানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বিশ্বসাহিত্যের প্রথম ঔপন্যাসিক মুরাসাকি শিকিবু। তিনি মৃত্যুবরণ করেন ১০১৪ খ্রিষ্টাব্দে। এক অভিজাত পরিবারে জন্ম। বাবা ছিলেন হেইয়ান সাম্রাজ্যের প্রাদেশিক গভর্নর। পদটি সম্মানজনক হলেও রাজধানীর রাজ-অমাত্যদের মতো সমান মর্যাদার ছিল না। অথচ নবম শতক থেকে তাদের অভিজাত গোষ্ঠীর ফুজিওয়ারারা সম্রাটদের পারিষদ হিসেবে দরবার আলোকিত করেছেন এবং প্রভাব খাটিয়েছেন। ফুজিওয়ারা ললনারা সম্রাজ্ঞী হয়েছেন। দশম শতকের শেষ এবং একাদশ শতকের শুরুতে শুধু ফুজিওয়ারা নো মিচিনাগা তাঁর চার কন্যাকে সম্রাটদের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন। এই ফুজিওয়ারা গোষ্ঠীর প্রভাব-প্রতিপত্তি তখন হেইয়ান সাম্রাজ্যে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিল।

মুরাসাকির জন্মের আগে জাপান বন্ধুহীন এবং বিচ্ছিন্ন এক সাম্রাজ্য ছিল। চীনের তেঙ সম্রাটদের আমলে (সপ্তম থেকে নবম শতক) জাপান থেকে ২০টি দল চীনে নানা মিশনে যায়। এরা ফিরে এসে জাপানের পুরো সাংস্কৃতিক পরিম-লে পরিবর্তন আনে। এতে চীনা ভাষা এবং সংস্কৃতির সংস্পর্শে গিয়ে জাপানের জাতীয় সংস্কৃতির এক শক্তিশালী উত্থান ঘটে। জাপানিরা ক্রমান্বয়ে কানা ভাষাকে চায়নিজ ভাষার বৈশিষ্ট্যে সমৃদ্ধ করে তুলতে থাকে। মুরাসাকির সময়ে পুরুষেরা চায়নিজ ভাষায় লিখতেন আর মেয়েরা কানা ভাষায়। দুই ভাষায়ই জাপানি সাহিত্য সমৃদ্ধ হতে থাকে।

মুরাসাকি শিকিবুর প্রতিকৃতি। Photo courtesy: Flickr

মুরাসাকি সে-সময়কার সৌভাগ্যবতীদের একজন। ছোট ভাইয়ের সঙ্গে চায়নিজ ক্লাসিক্যাল ভাষা এবং সাহিত্যে শিক্ষা লাভ করেছেন। মুরাসাকি শিকিবুর লেখা ডায়েরি থেকে জানা যায়, তাঁর ছোট ভাইকে এক গৃহশিক্ষক এ-ভাষা শেখাতেন। শুনে-শুনে মুরাসাকি এ-ভাষা শিখে ফেলেন। তাঁর ভাষা শেখার দক্ষতা দেখে তাঁর পিতা বলেছিলেন, তুই যদি আমার ছেলে হতিস, আমার জন্য তা হতো বড় সৌভাগ্যের। মনে করা হয়, তিনি ঐতিহ্যগতভাবে সাহিত্যের পাশাপাশি সংগীত, লিখনশৈলী এবং চিত্রকলায়ও সমান ব্যুৎপত্তি লাভ করেছিলেন। তবে তাঁর শিক্ষাটা সাধারণ্যে গৃহীতব্য ছিল না। কারণ তাতে প্রচলিত গোঁড়ামির প্রশ্রয় ছিল না।

মুরাসাকির বর ছিল তাঁর পিতার এক বন্ধু। পিতার প্রায় সমবয়সী। নাম ফুজিওয়ারা নো নোবুতাকা (৯৫০-১০০১ খ্রি.)। একই বংশ। সম্রাটের দরবারে চাকুরে, আমলা। অনুষ্ঠান-উৎসববিষয়ক মন্ত্রণালয়ে কাজ করেন। পোশাক-আশাকে অপচয়কারী। তবে প্রতিভাবান নৃত্যশিল্পী। তাঁর অনেক বাড়িঘর, আর ছিল অজ্ঞাতসংখ্যক স্ত্রী এবং রক্ষিতা। মুরাসাকির সঙ্গে বিয়ের পরও এ-ভদ্রলোক অন্যদের সঙ্গে রোমান্টিক সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। প্রথা অনুসারে মুরাসাকি পিত্রালয়ে অবস্থান করতেন। স্বামী মাঝেমধ্যে সেখানে মিলিত হতেন। নোবুতাকা একাধিক প্রদেশের গভর্নর ছিলেন এবং বিপুল সম্পদের অধিকারী হন। তাদের এক কন্যা কেনসি (কাতাইকো) ৯৯৯ সালে জন্মগ্রহণ করে। এর দুবছর পর নোবুতাকা কলেরায় মারা যান।

স্বামীর মৃত্যুতে মুরাসাকি ভেঙে পড়েন। তিনি তাঁর ডায়েরিতে সে-সময়কার অনুভূতির কথা বর্ণনা করেছেন এভাবে – ‘আমি মানসিক চাপের মধ্যে বিষাদগ্রস্ত হয়ে গেলাম। দ্বন্দ্ব-সংঘাত এবং সিদ্ধান্তহীনতা পেয়ে বসল আমাকে। কয়েক বছর এতটাই উদাসীন হয়ে রইলাম যে, সময় আর পোশাক-পরিচ্ছদের কোনোই ঠিক-ঠিকানা রইল না। আমার অশেষ নিঃসঙ্গতা এক সময় খুবই অসহ্য হয়ে উঠল।

মুরাসাকি শিকিবু স্বামীর মৃত্যুর পর ইম্পেরিয়াল লেডি-ইন-ওয়েটিং হিসেবে সম্রাটের অমত্মঃপুরে প্রবেশ করেন। তাঁকে জাপানের রানি ‘লেডি-ইন ওয়েটিং’ করবার জন্য অনুমোদন করেছিলেন। রানি আকিকো তাঁর এই বিদ্যানুরাগের খবর পেয়েছিলেন হয়তো।

উপন্যাসের প্লট

তিনি রাজদরবারে গিয়ে ওখানে থাকতে শুরু করেন। তারপর ভালোমতো এই রাজদরবারের ইতিহাস নিয়ে খোঁজখবর করেন। এছাড়া প্রতিদিন সেখানে কী ঘটছে তার একটা ডায়েরিও রাখতেন। যে ডায়েরি আজো আছে। সেই গোপন জগতের সব ঘটনা যা দেখেছেন, যা শুনেছেন সব লিখে রাখেন। ঠিক সেইসময় তিনি একটি উপন্যাস লিখতে শুরু করেন। এইভাবে লিখতে লিখতে চুয়ান্ন পর্ব লেখা হয়ে যায়। আর এটিই পৃথিবীর প্রথম উপন্যাস।

উপন্যাসের কাহিনি খুব সংক্ষেপে এরকমঃ-

সম্রাট কিরিতসুবোর দ্বিতীয় সন্তান গেঞ্জি। তিন বছর বয়সে গেঞ্জির মাতৃবিয়োগ ঘটে। উপপত্নীর সন্তান হলেও সম্রাট তাকে খুব পছন্দ করতেন। সম্রাট তাঁর সন্তানের মায়ের কথা ভুলতে পারেন না। সম্রাট এমন এক রমণীর কথা শুনলেন, যে কিনা দেখতে তাঁর পরলোকগত উপপত্নী, গেঞ্জির মায়ের মতো। এই মহিলার নাম ফুজিতসুবো। তিনি পূর্ববর্তী এক সম্রাটের কন্যা। সম্রাট তাঁকে বিয়ে করলেন। গেঞ্জি এ-মহিলাকে মান্য করে। তাঁর কাছে লালিত-পালিত হয়।

যৌবনে উপনীত হয় গেঞ্জি। অত্যন্ত সুদর্শন, ‘হিকারো’ বা সাইনিং গেঞ্জি। তবে রাজনৈতিক কারণে অবনমিত মর্যাদায় নিম্ন পর্যায়ের রাজকর্মচারী হিসেবে তাকে কর্মজীবন শুরু করতে হয়। এ সময় হিকারো গেঞ্জি তাঁর সৎমা ফুজিতসুবোর প্রেমে পড়ে যায়। তাদের মধ্যে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়।

তার আগে নো অয়ী নামের এক যুবতীর সঙ্গে বিয়ে হয় গেঞ্জির। সৎমায়ের সঙ্গে সম্পর্কের কথা জেনে গেলে তাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। গেঞ্জির সঙ্গে ফুজিতসুবোর অবৈধ সম্পর্কের কথা প্রকাশ পেয়ে গেলে গেঞ্জি খুব হতাশ হয়ে পড়ে।

স্ত্রীর সঙ্গেও সম্পর্ক খারাপ। তখন সে অনেক নারীর সঙ্গে অতৃপ্ত ও অসম্পূর্ণ প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাকে অবজ্ঞা ও বোকামির শিকার হতে হয়। কেউ-কেউ তাকে হতাশ করে অসময়ে মারাও যায়।

একবার সে দেখতে পায় এক সুন্দরী মহিলা তার জানালায় দাঁড়িয়ে আছে। গেঞ্জি অনুমতি ছাড়াই তার কক্ষে প্রবেশ করে। মহিলাকে বিছানায় যেতে বাধ্য করে। ক্ষমতাধর ব্যক্তি বলে মহিলা গেঞ্জিকে বাধা দেয় না।

আরেকবার গেঞ্জি উত্তর পল্লির কিতাইয়ামা পাহাড়ি এলাকায় ভ্রমণে যায়। কিতাইয়ামা কিয়োটোতে অবস্থিত। সেখানে সে দশ বছর বয়সী এক মেয়েকে দেখতে পায়। মেয়েটি দেখতে ঠিক ফুজিতসুবোর মতো। সে এ-বালিকাকে অপহরণ করে নিজ বাড়িতে নিয়ে আসে এবং ফুজিতসুবোর মতো তাকে শিক্ষিত ও মার্জিতভাবে গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়। মেয়েটির নাম মুরাসাকি। এ-সময় গেঞ্জি গোপনে সম্রাজ্ঞী ফুজিতসুবোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। তাতে সম্রাজ্ঞী সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়েন। সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে এই ছেলের নাম রাখা হয় রেইঝেই। এরা দুজন ছাড়া সবাই জানে এই ছেলের পিতা সম্রাট কিরিতসুবো। পরে এই ছেলে ক্রাউনপ্রিন্স এবং লেডি ফুজিতসুবো সম্রাজ্ঞী হন। গেঞ্জি এবং ফুজিতসুবো প্রতিজ্ঞা করে যে, এরা এ গোপন তথ্য কখনো ফাঁস করবে না। সবকিছু গোপন রাখবে।

এ গোপনীয়তার মধ্যে গেঞ্জি এবং তার স্ত্রী অয়ীর সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়। তার স্ত্রী একটি সন্তান জন্ম দেয়। তবে সন্তানটি মারা যায়। গেঞ্জি দুঃখ পেয়ে আবার হতাশ হয়ে পড়ে। দুঃখ ভুলে যাওয়ার জন্য গেঞ্জি এবার মুরাসাকিকে কাছে পায়। তাকে নিয়ে ভোগবিলাসে মত্ত হয়ে ওঠে এবং এক সময় তাকে বিয়ে করে।

গেঞ্জির পিতা সম্রাট কিরিতসুবো এ-সময় মারা যান। তার বড় ছেলে সুজেকো সম্রাট হন। সম্রাটের মাতা কোকিডেন কিরিতসুবোর রাজনৈতিক শত্রম্নদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পুত্রের ক্ষমতা সংহত করেন।

গেঞ্জি রাজদ–র ব্যাপারে মোটেও উৎসাহী নয়। এ-সময় তার আরেকটি গোপন প্রেমের তথ্য প্রকাশ হয়ে পড়ে। সম্রাট সুজেকো গেঞ্জির সঙ্গে তার এক রক্ষিতার মিলনদৃশ্য দেখে ফেলেন। সম্রাটের এই গোপন রক্ষিতার কথা শুধু গেঞ্জি জানত।


সম্রাট রক্ষিতাকে উপভোগের বিষয়টি শুধু তার ভাই গেঞ্জিকে বলেছিলেন। সম্রাট বিশ্বাসভঙ্গের কারণে গেঞ্জিকে শাস্তিস্বরূপ প্রত্যন্ত হারিমা প্রদেশের সুমা নগরীতে পাঠিয়ে দেন। সুমা নগরীতে আকাশি নভিস নামে পরিচিত এক ভদ্রলোক গেঞ্জিকে আতিথ্য দেন। গেঞ্জি আকাশির এক কন্যার প্রেমে পড়ে যায়। সে-প্রেমের ফসল হিসেবে এক কন্যাসন্তানের জন্ম হয়।

এদিকে রাজধানীতে সম্রাট সুজেকো তার বাবাকে স্বপ্নে দেখে মানসিক বিপর্যয়ের শিকার হন। তার হৃদয় ভেঙে যায়। মা কোকিডেন অসুস্থ। তার সিংহাসন ধরে রাখার ক্ষমতা নেই। এই মানসিক অবস্থায় সম্রাট গেঞ্জিকে ক্ষমা করে দেন। গেঞ্জি রাজধানী কিয়োটোতে প্রত্যাবর্তন করে। এ পর্যায়ে সম্রাটের ভ্রাতা রেইঝেই সম্রাট হন। গেঞ্জি রাজকর্মচারীর কাজে ইস্তফা দেয়। এক সময় নতুন সম্রাট জানতে পারেন যে, গেঞ্জিই তার আসল পিতা। সম্রাট পিতার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে গেঞ্জিকে সর্বোচ্চ রাজপদ প্রদান করেন।

বয়সের কারণে গেঞ্জির স্বাস্থ্যের অবনতি হতে শুরু করে। দুর্বল স্বাস্থ্যের জন্য রাজকীয় মর্যাদা ক্ষুণ্ণ না হলেও গেঞ্জির প্রেম ও আবেগময় জীবনে ধীরে-ধীরে অধঃপতন নেমে আসে। সে আরেকটি বিয়ে করে। তাকে ‘ওন্যা সান নো মিয়া’ অর্থাৎ থার্ড প্রিন্সেস বা তৃতীয় রাজকুমারী বলা হয় (এ-নামে জাপানের কানসাইতে একটি শহর রয়েছে)। এই রাজকুমারীর সঙ্গে গেঞ্জির ভাইপোর প্রেম এবং দৈহিক সম্পর্ক তৈরি হয়। তাতে জন্ম হয় প্রিন্স কাওরোর। সবাই জানে কাওরো গেঞ্জির সন্তান, আসলে তা নয়।

বৃদ্ধ বয়সে গেঞ্জির বিয়ে মুরাসাকির সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ ঘটায়। মুরাসাকি ‘বিকুনি’র (সন্ন্যাসিনী) জীবন বেছে নেন। সন্ন্যাসিনী অবস্থায় মুরাসাকি মারা যান। এ মৃত্যু গেঞ্জিকে গভীরভাবে ভাবিয়ে তোলে। জীবনের কি তা হলে এই পরিণতি? মৃত্যুচিন্তা তাকে পেয়ে বসে। গেঞ্জি এক সময় মারা যায়।

উপন্যাসটি এখানে শেষ হতে পারত। কিন্তু তা বাড়ানো হয়েছে গেঞ্জির পরবর্তী আরো দুই প্রজন্ম পর্যন্ত। উপন্যাসের ৪৫ থেকে ৫৪ অধ্যায় পর্যন্ত তার ব্যাপ্তি। এ অধ্যায়গুলোকে বলা হয় ‘টেন উজি চ্যাপ্টার’। উজির পটভূমিতে এ অধ্যায়গুলো রচিত বলে এরকম নাম। এ অধ্যায়গুলোও প্রেম আর বিরহের।

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *