• June 27, 2025

Chalachchitra

Explore the magic of Bengali cinema and culture

মৃত মানুষের সাথে ছবি: ভিক্টোরিয়ান যুগের এক অদ্ভুত প্রথা

ByDidarul Islam Himel

Jan 9, 2024

রাণী ভিক্টোরিয়া ১৮৩৭ থেকে ১৯০১ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৬৫ বছর ইংল্যান্ড শাসন করেন। ভিক্টোরিয়ার স্বামী প্রিন্স অ্যালবার্টের মৃত্যুর পর তিনি সম্পূর্ণ কালো বর্ণের জামা পরিধান করতে শুরু করেন। ঘোষণা করেন যে, তিনি তার স্বামীর জন্য শোক প্রকাশ করছেন এর দ্বারা। বাকি জীবন কালো জামাই পরিধান করেছেন রানী ভিক্টোরিয়া।

তখনকার ব্রিটিশদের কাছে এই ঘটনাটি অত্যন্ত শোচনীয় ও একইসাথে আবেগময় এক ঘটনা হিসেবে পরিচিত। মানুষের মাঝে তাই প্রিয়জনের প্রতি শোক প্রকাশের মাধ্যমটাও গ্রহণযোগ্যতা পেতে শুরু করলো।

সময়ের সাথে সাথে শোকের মাধ্যমগুলোও বিবর্তিত হতে থাকে। সাধারণ মানুষজন মৃতের স্বহস্তে লিখিত উইলনামা, চুলের তৈরি অলংকার, শোক প্রকাশক আংটি, শোক পোশাক, মৃতের স্কেচ, মৃতদেহের প্রতিমূর্তি, চিঠি ও স্মৃতিচারক চিত্র সম্বলিত কার্ড সংরক্ষণ করে মৃতের শোক পালন করতো।

তবে শোকপালনের সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ও আশ্চর্যজনক আরেকটি পদ্ধতি ছিলো মৃতের সাথে ফটোসেশন।

১৮ শতকের য়ুরুর দিকে ক্যামেরায় ফটোগ্রাফি পদ্ধতি শুরু হয়। প্রথম দিকে ছবি তোলা ও খরচ খুবই ব্যায়বহুল ছিলো। তবে ১৮৫০ ও ৬০ এর দশকে ক্যামেরায় ছবি তোলা খুবই সস্তা হয়ে যায়। সেসময়টায় যখন রাণী ভিক্টোরিয়ার স্বামীর মৃত্যুর শোক নিয়ে একটা ট্রেন্ড সাধারণ মানুষের দিয়ে বয়ে গেছে। তাই সাধারণ মানুষ শোকের জন্য অন্য মাধ্যমগুলোর মতো ক্যামেরায় ছবি তোলার দিকে ঝুঁকে পরে। এটা ছিলো শোক প্রকাশের সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম।

মৃতের ছবি তোলা প্রথম শুরু হয় পুলিশ কেইসের মাধ্যমে। তবে সেই ছবি আইন ও আদালতের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকতো। আর এই ছবি তোলাটাই ব্রিটিশরা নিজেদের শোক প্রকাশের মাধ্যম বলে বেছে নিয়েছেন।

১৮৬০ এর দশকে ইংল্যান্ড ডিপথেরিয়া, টাইফাস এবং কলেরার মতো মহামারীতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে উঠে। ফলে বেশিরভাগ শিশুরাই কৈশোরে পৌছানোর আগে মারা যেতো।

ডিফতেরিয়া, কলেরার মতো মহামারির কারনে বেশিরভাগ শিশু বয়স ৫ এ পৌঁছানোর আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তো। ছবিতে যে সবচেয়ে ছোট শিশুটি দেখছেন, সে মৃত। ছবি দেখে বোঝার উপায় নেই ঢ়ে শিশুটি মৃত। শিশুটির বাবা মা তার শেষকৃত্যের আগে তার ভাই বোনদের সাথে ছবি তুলেছেন যেনো তা তাদের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে থাকে।

যেহেতু ক্যামেরাতে ছবি তুলে রাখাটা সহজলভ্য হয়ে গেলো মানুষের কাছে, তখন তারা ভাবলো প্রিয়জনদের সমাহিত করার পূর্ব মুহূর্তকার চেহারা স্মৃতিচারণ করতে ছবি তুলে রাখা প্রয়োজন। সেই সময়ে ছবি তোলার সময়ে মানুষদের বেশ কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো, সামান্য নড়াচড়া করলেই যে ছবির ঝাপসা হয়ে যাবে। ঠিক এ কারণেই পুরনো ছবিগুলোতে আমরা দেখতে পাই মানুষ চোখ-মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে কিংবা বসে আছে। তাই মৃতদেহের ছবি তোলা অনেকখানি সহজ হয়ে এলো, যে মারা গিয়েছে তার তো আর নড়াচড়া করবার কিছু নেই, ছবি ঝাপসা হয়ে যাবার ভয়ও নেই।

মৃত সন্তানের সাথে ছবি তুলছেন বাবা মা

প্রায় সকল পরিবারই তাদের মৃত সদস্যের সাথে ছবি তুলতো। তাদের মনে হতো এই মানুষটার প্রতিকৃতি না থাকলে হয়তো মানুষটা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে। একপ্রকার নিজেদের পরিবারের মৃত সদস্যকে নিজেদের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখতে তারা ছবি তুলতো।

মৃতের ছবি তুলার পর মৃতের চোখ বন্ধ থাকতো। ছবিকে জীবন্ত করতে ফটোগ্রাফাররা নতুন চোখ বসিয়ে দিতেন।

প্রথমদিকে এই ধরণের ছবিগুলো সাধারণ মানুষের কাছে ‘মিররস উইথ ম্যামোরিস’ নামে পরিচিত ছিল। ছবিগুলো পরিবারের বাড়ির দেয়ালে প্রদর্শিত হতো কিংবা আত্মীয় স্বজনদের দেওয়া হতো, নিজেদের মানিব্যাগে রাখতেন, অনেকে নিজেদের লেকেটের ভেতর স্মৃতি চিহ্ন হিসেবে রেখে পরিধান করতেন।

যমজ শিশু যাদের মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়েছে।

মৃতের ছবি তোলা ও তার সাথে গ্রুপ ছবি তোলা কেবল যে শুধুমাত্র ইংল্যান্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো তা কিন্তু নয়! ইংল্যান্ড ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অনেক দেশেই মৃতের ছবি তোলার প্রথা প্রচলন ছিলো।

বিংশ শতাব্দীতে দাড়িয়ে আপনার এইধরনের কাজগুলোকে অদ্ভুত ও অস্বাভাবিক মনে হলেও, বাস্তবিক অথে এই ছবিগুলো সেসময়ের অনেক পরিবারের দুঃখ কিছুটা কমানোর সুযোগ করে দিয়েছিলো।

সহপাঠীর অকালেই মৃত্যু হয়েছে তাই সকল সহপাঠী তাদের মৃত সহপাঠীর সাথে গ্রুপ ছবি তুলছে। Source: William Clement’s Library

বেশিরভাগ ছবির ক্ষেত্রেই মৃতদেহগুলিকে সুন্দরভাবে সাজানো হতো এবং খেলনা দিয়ে ঘেরা ছিল (যদি তারা বাচ্চা হয়)।

মৃতের ছবি তোলার প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত সাবধানের সাথে করা হতো। মৃতের ফটোগ্রাফি মৃতের বাড়িতে বা মৃতের কক্ষেও করা হতো। তবে প্রাপ্ত বয়স্ক মৃতদের ছবি বেশিরভাগই কফিনে শোয়ানো অবস্থায় তোলা হতো। মৃতের ছবিতে আরো সৃজনশীলতা যোগ করতে কখনো কখনো মৃতকে চেয়ারে বসাতো।
অনেকে আবার মৃতের ফটোশেসনের সময় মৃতের হাতে বই ধরিয়ে দিতো।

বেশিরভাগ সময়ই মৃতের ছবি তোলার সময় ফটোগ্রাফাররা এমন কায়দা ও পদ্ধতি অবলম্বন করে ছবি তুলতেন যেনো মৃত ব্যক্তিকে জীবিত মনে হয়।

Ezoic

১৯৩০ এর দশক থেকে মৃতের ছবি তোলার প্রথা বন্ধ হতে শুরু করে। মূলত সামাজিক পরিবর্তন এই প্রথাকে বিলুপ্তির দিকে ঠেলে হয়। মানুষজন এই প্রথাকে অসুস্থ ও বর্বর প্রথা মনে করতে শুরু করেছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *