• June 16, 2025

Chalachchitra

Explore the magic of Bengali cinema and culture

হারেম: নিষিদ্ধ যৌন জীবনের উপাখ্যান

ByDidarul Islam Himel

Jan 6, 2024

হারেম শব্দটি তুর্কি শব্দ। কেউ কেউ বলেন হারেম শব্দটি আরবি শব্দ হারাম থেকে এসেছে। যার অর্থ নিষিদ্ধ। সহজ ভাষায় হারেম অর্থ মহিলাদের জন্য নির্ধারিত স্থান, যেখানে সাধারণ পুরুষদের প্রবেশ নিষিদ্ধ।
নিষিদ্ধ ছিলো বলেই ডেই সময়কার পুরুষদের কাছে হারেম ছিলো অতি আগ্রহের জায়গা।

হারেম শব্দটি শুনলেই প্রথমে চোখে ভেসে উঠে শত শত সুন্দরী রমণী আর তার মাঝে কোনো রাজা/সম্রাট নিজের অবৈধ প্রণয় লীলা চালাচ্ছেন।

Image credit: sohojia

হারেমের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় তুর্কি সাম্রাজ্যে। মোঘল সম্রাজ্যের হারেম ও ছিলো অতি বিখ্যাত। তবে অন্য সাম্রাজ্যেও হারেম ছিলো। ইউরোপ কিংবা চীন সাম্রাজ্যেও হাটেমের উল্লেখ পাওয়া যায়। আসলে হারেম প্রায় সব রাজাদেরই ছিলো। তবে তুর্কী ও মোঘলদের হারেম ছিলো অন্যদের চেয়ে বহুগুণে প্রসিদ্ধ।

হারেমে যে কেবল সম্রাটের ভোগপণ্য সুন্দরী রমণী ও রাণীরাই থাকতো এমন ধারণা একেবারেই ভুল। হারেমে সুন্দরী রমণী নারীরা ছাড়াও সম্রাটের স্ত্রী, মা,মহিলা আত্মীয়, সাদা কালো খোজা যারা ছিলো হারেমের পাহারাদার, সম্রাটের অবিবাহিত কণ্যারা, এছাড়াও সম্রাটের যুবরাজরাও এই হারেমেই বেড়ে উঠতেন।

হারেম ছিলো একটা ছোটখাটো রাজ্যের মতো। সম্রাটের নিজের লোকজন সহ বিভিন্ন দেশ থেকে আসা রমনীদের সংখ্যা ছিলো ২-৩ হাজারের অধিক। হারেমের দাসী পাহারাদার সব মিলিয়ে গড়পড়তায় একটি হারেমেই লোকজন ছিলো প্রায় ৫ হাজারের কাছাকাছি। বিশেষত তুর্কী হারেমে এই সংখ্যাটা বেশিই থাকতো। তবে অন্য সম্রাজ্যের হারেমে এই সংখ্যা কিছুটা কম। তবে এর চাইতেও বেশি সংখ্যা পাওয়া পাওয়া যায় দক্ষিণ ভারতের রাজাদের হারেমে। দক্ষিণ ভারতের রাজাদের যৌনদাসীই নাকি থাকতো ১০ থেকে ১৫ হাজারের অধিক।

বিশেষ করে তুর্কি হারেম ছিলো ছোটখাটো একটা রাজ্যের মতো এই হারেমে স্কুল, দোকান, রসুইঘর, মসজিদ, কারাগার, হামাম, বাগিচা, বস্ত্রালয় ও রত্নশালা প্রায় সবই ছিলো।

রাজাদের একাধিক পত্নী উপপত্নী থাকবে তখনকার সময়ে এটাই ছিলো স্বাভাবিক বিষয়। মোঘল আমলের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় মোঘল সম্রাট আকবরের ছিলো ১১ জন স্ত্রী, সম্রাট হুমায়ূনের ছিল ১২ জন, সম্রাট আকবরের ছিলো ৪০ জনের অধিক স্ত্রী, সম্রাট জাহাঙ্গীরের ছিল ২৫ জন, সম্রাট শাহজাহানের ছিল ৯ জন, সম্রাট আওরঙ্গজেবের ছিলো ৫ জন।

সম্রাটেরা প্রতিদিন তাদের হারেম থেকে এক বা একাধিক সুন্দরী রমণী পছন্দ করে নিজের শয্যাসঙ্গী করতেন। এই রমণীরা ছিলো দেশ ও পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগমন করা সুন্দরী রূপসী। সম্রাটের শয্যাসঙ্গী হিসেবে হারেম থেকে অগ্রাধিকার পেতেন হারেমে থাকা কুমারী রূপসীরা। সম্রাটের শয্যায় পাঠানোর আগে সেই রমনীকে অন্য দাসী ও নারীরা তাকে দুধ ও গোলাপে স্নান করিয়ে বিভিন্ন অলংকার ও প্রসাধনী ব্যবহার করে এবং দামী বস্ত্র পরিধান করিয়ে তাকে সুসজ্জিত করা হতো। সম্রাটের কাছে কেউ একবার ব্যবহার হয়ে যাওয়া বস্ত্ দ্বিতীয়বার পরিধান করে যেতো না। প্রতিবার নতুন বস্ত্র পরিধান করে যেতে হতো।

হারেমের জন্য সুন্দরী রূপসী নারী সংগ্রহ করা হতো কিভাবে?

যে সম্রাট বা রাজা বা সুলতান যত বেশি অভিজাত, ক্ষমতাশালী ও অর্থবিত্তের অধিকারী তার হারেমে নারীর সংখ্যাও তত বেশি থাকত। তখনকার রাজা বাদশাহদের আমলে যুদ্ধবিগ্রহ কম-বেশি লেগেই থাকত।

আর যুদ্ধে পরাজিতদের স্ত্রী কন্যাকে দাস-দাসী হিসেবে হারেমে নিয়ে আসা হতো। কখনো বিয়ে কিংবা উপঢৌকন হিসেবে কাউকে আনা হতো।

কাউকে দাসীরূপে ক্রয় করে আনা হতো। সেই দাসী কাল ক্রমে জায়গা পেত সম্রাটের হারেমে।

এছাড়া সম্রাটের কোনো অনুচর তাকে জানাল যে, অমুক জায়গায় অমুকের একটা সুন্দর মেয়ে আছে। সম্রাট বলে দিতেন ঠিক আছে তাকে হারেমে নিয়ে আস। অনুচরেরা তাকে হারেমে নিয়ে আসত।

কিংবা কোনো কৃষক খাজনা দিতে ব্যর্থ হলে খাজনাস্বরূপ তার পুত্র-কন্যাকে তুলে নেওয়া হতো। পুত্রকে দাস হিসেবে রাজার কাজে লাগানো হতো এবং কন্যাকে দাসী হিসেবে হারেমে প্রেরণ করা হতো। এভাবে নানা উপায়ে হারেমে নারী সংগ্রহ করা হতো।

হারেমের ভোজনবিলাস

হারেম হচ্ছে স্বর্গ, সুখের স্বর্গ! সারাদেশে দূর্ভিক্ষ লেগে থাকলেও হারেমে উচ্চাবিলাসী খাবারের অভাব ঘটতো না কখনো। তুর্কী হারেমে নাকি রসুইঘরই থাকতো ১০ টার অধিক। আর সুঅভিজ্ঞ পাচক থাকতো ১৫০ এর অধিক। এছাড়া জ্বাল, মশলা, জিনিসপত্র এগিয়ে কাটাকুটির জন্য থাকতো আরো অনেক ভৃত্য। প্রতিদিন নাকি ২০০ গাড়ি জ্বালানিই লাগতো হারেমের উনুন জ্বালানোর জন্য!

সবচেয়ে বেশি সতর্ক থাকা হতো সুলতানের খাদ্য সম্পর্কে। সুলতানের রসুইঘর ছিলো হারেমের অন্য রসুইঘর থেকে একদম আলাদা। রান্নার অর্ধেক শেষ হলে তা প্রাসাদে নিয়ে যাওয়া হতো, কারন বাকি কাজ সেখানেই হতো। সবশেষে সুলতান খাবার টেবিলে বসার আগে খাবারে মেশানো হতো বিশেষ মশলা। এরপর সুলতান খেতে বসতেন একা, এরপর খেতো রাণী দাসী বাদী ও হারেমের রূপসীরা। তারা যা খুশি খেতেন। দেশে লক্ষ লক্ষ প্রজা হয়তো অনাহারে দিন কাটাচ্ছে কিন্তু হারেমে অঢেল খাদ্য।

একটি তুর্কী হারেমে দৈনিক খাবারের ফর্দ ছিলঃ- কচি ভেড়া ২০০ টি, ভেড়া ১০০ টি, গরু ৪ টি, মোরগ ২০০ টি, মুরগী ২০০ টি, রাজহাঁস ২০ টি, কবুতর ২০০ টি। এর সাথে ছিলো পোলাও, মিঠাই, শরবত সহ আরো অনেক বিলাসী খাবার। প্রতিদিন সে সময়ে হাটেমের একদিনের খাবারের খরচই হতো লক্ষ টাকার অধিক। আজকের এই দিনে সেই টাকার পরিমান কত হতে পারে একবার চিন্তা করে দেখুন তো!

এছাড়া ভোজন বিলাস ছাড়াও সম্রাট বিনোদের জন্য হারেমে সঙ্গীত কিংবা নৃত্যের আয়োজনের ও ব্যবস্থাও করতেন।

একটি তুর্কী হারেমের সঙ্গীত ও নৃত্যের ছবি Image credit: alforja

হারেমের অন্যতম সদস্য খোজা

হারেমের একমাত্র প্রধান আকর্ষণ ছিলেন সম্রাট বা সুলতান। সুলতান একমাত্র পুরুষ যিনি হারেমে প্রবেশ করতে পারতেন। সুলতান ছাড়া অন্য কেউ হারেমে প্রবেশ করলে তার জন্য মৃত্যুদন্ড ছিলো অনিবার্য। সুলতান তার হারমের সুরক্ষিত করতে নিয়োগ করতেন খোজাদের কে।খোজা মূলত পুরুষ কিন্তু তাদের পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলা হতো। পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলার কারন হচ্ছে যাতে তারা হারেমের সুন্দরীদের ভোগ করতে না পারে। খোঁজা তৈরি করার জন্য সে সময় ক্রীতদাস ব্যবসায়ীরা ছোট ছেলেদের যৌনাঙ্গ কেটে ফেলতো। দেখা যেতো একজন খোজা বানাতে গিয়ে ৩০ জনের মৃত্যু হচ্ছে। যেই একজন বেঁচে যেতো সেই একজনকে তারা সুলতানের কাছে চড়া দামে বিক্রি করতো। এই খোজারা হতেন অনেকটা মেয়েলি স্বভাবের তারা গান, নৃত্য, কবিতা ভালোবাসতেন যেমনটা নারীরা ভালোবাসতেন। নারীদের প্রায় সব স্বভাবই তাদের মধ্যে থাকতো। একটি হারেমে খোজা থাকতো ১০০ থেকে ১৫০ এর অধিক। খোজাদের মধ্যে শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ দু রকমের খোজা ছিলো। শোনা যায় সুলতানরা নাকি এই শ্বেতাঙ্গ খোজাদের সাথে নিজের বিকৃত যৌনাচার ও চালাতেন।

মুঘল হারেমের খোজা Image credit: India express

মাঝেমধ্যে এই খোজাদের মধ্যে নতুন করে পরুষত্ব জেগে উঠতো। তারা লুকিয়ে লুকিয়ে হারেমের রূপসীদের ভোগ করতো। হারেমের রূপসীরাও তা গোপন রাখতো। হারেমের কোনো খোজার নতুন করে পুরুষত্ব জেগে উঠেছে এমন খবর সুলতানের কাছে গেলে সুলতান তা হেকিম কে দিয়ে পরীক্ষা করতেন এবং আবার তার অস্ত্রপ্রাচার করতেন। ফলে দেখা যেতো বেশিরভাগ খোজারই মৃত্যু হতো।

হারেমের অন্যতম জায়গা হামাম

হারেমের সবচেয়ে অভিনব আয়োজন গুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে হামাম। হামাম অর্থ স্নানাগার। এই হামামের ক্ষেত্রে মুঘল কিংবা অন্য সাম্রাজ্যের হামাম থেকে তুর্কি হামামের জৌলুশ ছিলো অন্য মাত্রার।

একবার এক প্রত্যক্ষদর্শী তুর্কী হামামের বর্ণনা দিয়েছিলেনঃ- পৃথিবীতে এমন সুন্দর স্নানঘর দ্বিতীয়টি নেই। স্নানঘরের চারদিকে থাকতো জলের ফোয়ারা। জলের নলগুলো থাকতো সোনা ও রূপোয় মোড়ানো। পাত্রগুলো থাকতো থাকতো হীরা ও রৌপ্যমন্ডিত। সোনা ও রূপার সেই পাত্রে গরম ও ঠান্ডা উভয় জল থাকতো। মেঝে থাকতো দামী পাথরে মোড়ানো। দেয়ালে থাকতো গোপাল ও রমমারী সুগন্ধির উৎস। একবার চোখে দেখলে তার থেকে চোখ ফেরানো ছিল কষ্টকর।

একটি তুর্কী হামাম Image credit: Expact guide Turkey

একটি হারেমে হামাম ছিলো অনেকগুলো। হারেমের রূপসীরা সেখানে প্রায় সবাই একসঙ্গে স্নান করতেন। তাদের বেশিরভাগই তখন থাকতেন অর্ধনগ্ন কিংবা পুরোপুরি নগ্ন। সম্রাট / সুলতানরা কখনো কখনো লুকিয়ে লুকিয়ে সেই দৃশ্য উপভোগ করতেন।

হারেমের পরিসমাপ্তি

হারেমের পরিসমাপ্তি ঘটে উনিশ শতকের শুরু দিকে। হারেমে যে সকল নারী একবার প্রবেশ করতো তাদের বের হবার খুব একটা সুযোগ ছিলো না। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের শেষে সমাপ্তি ঘটেছিল মুঘল হারেমের। তার আরো অনেক পরে সমাপ্তি ঘটেছিল তুর্কি হারেমের কামাল পাশার মাধ্যমে। সেসময় নাকি নানা বয়সী প্রায় ৩৭০ জন নারী তুর্কী হারেমে ছিল।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *