বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এমন অনেক ধারা ছিল, যা একসময় দর্শকদের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গেছে বা ক্ষীণ হয়ে গেছে। এইসব ধারাগুলো শুধু বিনোদনের মাধ্যম ছিল না, বরং বাংলা সংস্কৃতি ও সমাজের বহুমাত্রিক রূপ তুলে ধরত। আজ আমরা সেইসব বিলুপ্তপ্রায় ধারার দিকে ফিরে তাকাব।
১. ঐতিহাসিক চলচ্চিত্র: হারিয়ে যাওয়া মহিমা
একসময় বাংলা সিনেমায় ঐতিহাসিক ঘটনা ও চরিত্র নিয়ে বেশ কিছু সিনেমা নির্মিত হতো। “সত্যজিৎ রায়ের শত্রুজিত”, “পদ্মা নদীর মাঝি”-এর মতো ছবি ইতিহাসের গভীরতা ও মানবিকতার চিত্র তুলে ধরেছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ধারাটি কমে গেছে। বর্তমান সময়ে ঐতিহাসিক সিনেমার সংখ্যা হাতে গোনা, কারণ এর জন্য গবেষণা, বিশাল বাজেট ও নির্ভুল নির্মাণ দরকার, যা অনেক নির্মাতার কাছে ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ মনে হয়।
২. বাংলা আর্ট ফিল্ম: বাণিজ্যিকতার ছায়ায় বিলীন
সত্তরের দশক থেকে নব্বইয়ের দশকের মধ্যে বাংলা সিনেমার একটি শক্তিশালী ধারা ছিল আর্ট ফিল্ম বা সমান্তরাল সিনেমা, যা মূলত বাস্তবধর্মী গল্প ও গভীর জীবনচিত্র তুলে ধরত। সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন—তাঁদের চলচ্চিত্রে সমাজের প্রতিচ্ছবি পাওয়া যেত। কিন্তু বর্তমান সময়ে এই ধারা প্রায় হারিয়ে গেছে।
এর কারণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— ১) বাণিজ্যিক সিনেমার আধিপত্য, যেখানে মূলত অ্যাকশন ও প্রেমকাহিনি দর্শকদের আকৃষ্ট করে। ২) প্রযোজকদের অনীহা, কারণ আর্ট ফিল্ম সাধারণত কম বাজেট ও সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে কাজ করে, যা সবসময় লাভজনক হয় না। ৩) দর্শকদের আগ্রহের পরিবর্তন—বর্তমান প্রজন্ম দ্রুতগতির সিনেমা পছন্দ করে, যেখানে গভীর চিন্তা বা ধৈর্যের প্রয়োজন হয় না।
৩. বিশেষধারার কৌতুক সিনেমা: এক হাস্যরসের হারানো অধ্যায়
একসময়ে বাংলা চলচ্চিত্রে ভিন্নধারার কৌতুক সিনেমার একটা শক্তিশালী ধারা ছিল। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, উত্তম কুমার এমনকি রবি ঘোষের মতো অভিনেতারা এই ধরনের হাস্যরসে দারুণ সফল ছিলেন। কৌতুক সিনেমা শুধুই বিনোদন দিত না, বরং সমাজের বিভিন্ন সমস্যাকে সূক্ষ্মভাবে তুলে ধরত।
কিন্তু বর্তমান সময়ে এই ধারা প্রায় বিলুপ্ত। কারণ— ১) সিনেমার গল্প পরিবর্তন হয়েছে, এখন হাস্যরস মূলত সিনেমার কিছু দৃশ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, পুরোপুরি কমেডি সিনেমা তৈরি হয় না। ২) অন্যান্য বিনোদনের মাধ্যমের উত্থান, বিশেষ করে ইউটিউব ও সোশ্যাল মিডিয়া, যেখানে ছোট ছোট কৌতুক ভিডিও দর্শক পছন্দ করে। ৩) আধুনিক কৌতুকের ধরন বদলে গেছে, আগের যুগের শুদ্ধ ও বুদ্ধিদীপ্ত হাস্যরসের পরিবর্তে এখন অনেকটাই চলতি ধাঁচের এবং কখনও কখনও অতিরিক্ত নাটকীয়।
শেষ কথা
বাংলা চলচ্চিত্রের হারিয়ে যাওয়া ধারাগুলো আমাদের সিনেমার ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এগুলো শুধু বিনোদন নয়, বরং আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি ও দর্শনের অনন্য বহিঃপ্রকাশ। যদিও সময়ের প্রবাহে এগুলো বিলীন হয়েছে, কিন্তু প্রয়োজনে ও চাহিদা থাকলে এই ধারাগুলো নতুনভাবে ফিরে আসতে পারে। হয়তো একদিন বাংলা চলচ্চিত্র আবার এইসব ভিন্নধারার সিনেমার জগতে পা রাখবে।
আপনার কোনো নির্দিষ্ট ধারা নিয়ে আরও গভীর বিশ্লেষণ দরকার হলে বলুন!