• June 9, 2025

Chalachchitra

Explore the magic of Bengali cinema and culture

ফারুকীর অন্যতম মাস্টারপিস ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’

“সৃষ্টির জন্য সম্ভবত খুব তীব্র কোনো যন্ত্রণা লাগে”, আমার নেক্সট বইয়ের ভূমিকা লেখা শুরু করেছি এই লাইনটা দিয়ে৷ সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি দেখে মনে হলো, ভুল কিছু লিখিনি। একমাত্র স্রষ্টাই জানেন সৃষ্টির পেছনের যন্ত্রণা। যে যন্ত্রণা যত বেশি তীব্র, সেই সৃষ্টি তত বেশি গভীর এবং সুন্দর। হ্যাটস অফ, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ভাই। সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি ইজ ইউর ওয়ান অফ দ্য মাস্টারপিস! অনেক কথা লিখতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু লিখতে গিয়ে আমার পুত্র জন্ম দেওয়ার স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছে আর সব কেমন যেন এলোমেলো লাগছে, চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। এই কয়টা লাইন লিখতে গিয়ে কতবার যে কী-বোর্ডে টাইপ করছি, আর মুছছি।

আমার পুত্রের জন্মও হয়েছিল ডাঃ সংযুক্তা সাহার হাতে। একইভাবে। সিজার করে। একই জায়গায়। সেন্ট্রাল হাসপাতালে। শেষ দৃশ্যের মধ্যে আপনার আর আমার মিল-অমিল শুধু এতটুকুই- আপনার ক্ষেত্রে নার্সরা ওই মন্তব্য করেছেন। আমার ক্ষেত্রে সন্তান জন্ম দেওয়ার ঘণ্টা খানিক আগে আমার নিজের জন্মদাত্রীই বলেছিলেন, ” হবে তো তোর মতো কালো! বাচ্চা সুন্দর না হলে আদর করতে মন চায়?” সন্তান জন্ম দেওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে নিজের মায়ের মুখে এমন কথা শুনতে আমার ঠিক কেমন লেগেছিল? এই অনুভূতি কি আমি লিখে প্রকাশ করতে পারবো কোনোদিন? জানি না। সম্ভব না বোধহয়।

তবে না, আমার পুত্র আমার মতো কালো হয়নি। সত্যি কথা বলতে কি জানেন? এ নিয়ে আমার একটু না, অনেক বেশি দুঃখ আছে। আমি চেয়েছিলাম আমার মতোই একটি কালো কন্যা সন্তান। যাতে আমি তাকে ওইসব দিয়ে বড় করতে পারি, যা আমি পাইনি। ওইসবের বিরুদ্ধে লড়তে শেখাতে পারি, যা আমাকে প্রতিনিয়ত ফেস করতে হয়েছে, ওইসব মানুষদের মুখে তামাচা মারার মতো যোগ্য বানাতে পারি, যারা প্রতিনিয়ত আমার যোগ্যতাকে আমার বর্ণ দিয়ে খাটো করতে চেয়েছেন। কিন্তু আল্লাহ আমাকে দিলেন একজন পুত্র সন্তান! এবং কী অদ্ভুত- দিলেন তো দিলেন, একদম বাবার কার্বন কপি বানিয়ে দুনিয়াতে পাঠালেন! কেন পাঠালেন, জানেন? এটা না করলে আমার পুত্র সম্ভবত পিতৃপরিচয়ের সংকটে পড়ে যেত। আল্লাহ এত বড় অন্যায় আমার সঙ্গে কিংবা আমার পুত্রের সঙ্গে হতে দিতে চাননি হয়তো। তাতে বিশেষ কোনো লাভ হয়নি অবশ্য। শুধু পিতৃপরিচয়টা নিশ্চিত করা গেছে চেহারার মাধ্যমে। ডিএনএ টেস্টের মতো ব্যাপার ঘটানো লাগেনি। অবশ্য যে পিতা নিজের সন্তানের পরিচয়কে অস্বীকার করে, তার পিতৃপরিচয় আদায় করার মধ্যে কোনো গর্ব বোধ আছে বলে আমি মনে করি না। তবুও আল্লাহর দয়া যে আমাকে সতী নারীর পরীক্ষা দেওয়া থেকে বাঁচিয়েছেন বায়োলজিক্যাল পিতা সাদৃশ্য পুত্র পাঠিয়ে। জন্ম দিলেই সবাই পিতা হতে পারেন না। এই বুঝ অবশ্য সমাজের খুব কম মানুষেরই আছে!

কী অদ্ভুত দুনিয়া! বর্ণ-ক্ষমতা, বিত্ত, কতকিছুতে আটকে থাকে, আটকে রাখে, আটকে দেয়। মাঝে মাঝে আমি মানুষের চেয়ে নিষ্ঠুর আর কিছু চোখেই দেখি না! আমি তো ফিল্মমেকার না, খুবই ক্ষুদ্র একজন লেখক। কিন্তু একদিন হয়তো আমিও আপনার মতো লিখে ফেলবো নিজের অটোবায়োগ্রাফিটা, যেখানে এ রকম আরো অসংখ্য যন্ত্রণার গল্প থাকবে, যেসবে আমার জন্ম নেওয়া কিংবা বেড়ে উঠাকে একটা অভিশাপ মনে হতো! যেন আমি এক সাক্ষাৎ পাপ! আর তা-ই হয়তো আমার আগামী কবিতার বই-এর নাম রেখেছি “সকল পুণ্যের মাঝে আমি একটাই পাপ”। দোআ করি, পৃথিবীর কোনো শিশুকে যেন এই অনুভূতি নিয়ে বড় হতে না হয়। এই সিনেমা নিয়ে আরো অনেককিছু লেখা যেতই না শুধু, লেখা উচিতও। সত্যি বলতে আমি এত বেশি আবেগাক্রান্ত হয়ে উঠেছি যে পারছি না। সব উলট-পালট হচ্ছে। এত অগোছালো লেখা বোধহয় বহুদিন পর লিখছি। পরে সময়-সুযোগ হলে অবশ্যই আরো বিস্তারিত আর গোছানো লেখা লিখবো আশা করি।

তিশা আমার ইউনিভার্সিটির ক্লাসমেট। ভিকারুননিসা কলেজে এক ব্যাচ সিনিয়র ছিলেন। তবে ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটিতে (আইইউবি) আমরা একটা কোর্স একসঙ্গে করেছি। মাঝে মাঝে সে সূত্রে তার ফোন কল পেতাম। বেচারি কোনো ক্লাস মিস করে ফেললে কাজ শেষ করে অনেক রাতে আমাকে টেক্সট করে জানতে চাইতেন ফোন দিতে পারবেন কি না। টেক্সট পেয়ে আমি নিজেই ফোন দিতাম। ক্লাসে কোনো এসাইনমেন্ট দিলে সে আমার গ্রুপে থাকতে চাইতেন, তাতে সম্ভবত স্বস্তি পেতেন। অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করে হয়তো পরদিন অনেক সকালে তাকে ক্লাস করতে আসতে হতো। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট থাকতো। প্রথম সেমিস্টারের পর অবশ্য আমাদের আর দেখা হয়নি। সেই সূত্রে আপনি আমার দুলাভাই বটে! হা হা হা। তবে বউয়ের ক্লাসমেট হিসেবে না, একজন সিনেমার সাধারণ দর্শক হিসেবে দাবি জানাই, আপনি নির্মাণের পাশাপাশি অভিনয়টাও করবেন। তিশা অভিনেত্রী, তার পর্দায় উপস্থিতি নিয়ে কিছু বলার নেই। উনি তো ভালো করবেনই। কিন্তু আপনার এই সাবলিল উপস্থিতি! ওহ মাই গড! অসাধারণ! ভেতরে এত বেশি গভীর দাগ কেটেছে, মনেই হয়নি আপনি অভিনয় করেছেন। সম্ভবত আপনি অভিনয় করেনওনি। তিশা আর আপনি- শুধুমাত্র এই দুজনই ছিলেন একদম সহজ, স্বাভাবিক এবং ন্যাচারাল! এক কথায় দুর্দান্ত! হয়তো এখানে আপনাদের আবেগ জড়িয়ে আছে বলেই আপনারা পেরেছেন আপনারা হয়েই থাকতে। অনেক ভালোবাসা ভাই; আপনাকে, তিশাকে এবং রাজকন্যা ইলহামকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *