• October 19, 2025

Chalachchitra

Explore the magic of Bengali cinema and culture

‘ষ’- ওটিটি কন্টেন্টের জগতে এক নতুন মাইলফলক!

ByDidarul Islam Himel

Jan 17, 2024

‘ষ’ এর ক্রেডিট রোলে খেয়াল করলাম শুধু রাইটিং, ডিরেকশন এবং এডিটিংই না, পোস্টার, সিজি এমনকি টাইপোগ্রাফি ডিপার্টমেন্টেও নুহাশ কাজ করেছেন৷ কাজের প্রতি নুহাশ কতটা ডেডিকেটেড তা তার প্রতিটা কাজেই যত্নের ছাপ দেখে বোঝা যায়। চরকির এই অ্যান্থোলজি সিরিজ হরর জঁনরায় শুধু বাংলাদেশে না, বাংলা ভাষার সব কাজগুলোর মধ্যেই একটা বেঞ্চমার্ক হয়ে থাকবে নিঃসন্দেহে…

যে কোনো কন্টেন্ট দেখার পরে এর এন্ড ক্রেডিট রোল দেখাটা আমার বেশ পুরাতন অভ্যাস। ‘ষ’ এর ক্রেডিট রোলে খেয়াল করলাম শুধু রাইটিং, ডিরেকশন এবং এডিটিংই না, পোস্টার, সিজি এমনকি টাইপোগ্রাফি ডিপার্টমেন্টেও নুহাশ কাজ করেছেন৷ নুহাশ কাজের প্রতি কতটা ডেডিকেটেড তা তার প্রতিটা কাজেই যত্নের ছাপ দেখে বোঝা যায়। শারদ, মন্দিরা দিয়ে এমন হৃদয় কাঁপানো ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক! প্রতিটা আলাদা এপিসোডে আলাদা দেশি ইন্সট্রুমেন্টের ব্যাবহার বেশ চমকপ্রদ ছিলো। ‘ষ’ এর সবগুলা এপিসোডই আলাদা ভাবে ভালো লেগেছে, হয়তো কোনোটা কম কোনোটা বেশি৷ অপেক্ষা করছিলাম, সব গুলো এপিসোড দেখার পর লিখবো এই সিরিজ নিয়ে।

*স্পয়লার অ্যালার্ট*

এই বিল্ডিংয়ে মেয়ে নিষেধ

আমাদের লোকগল্প গুলার মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় মেছোপেত্নীর গল্প। সন্ধ্যার পরে মাছ কিনে বাড়ি ফেরা লোকের মাছ কেড়ে নেয়া, রাতে বিলের মধ্যে লম্বা লম্বা পা ফেলে মাছ ধরা বা বড় হাত ঢুকিয়ে রান্নাঘরের জানালা দিয়ে ভাজা ইলিশ মাছ নেয়ার গল্প। এগুলার সাথে আমরা ছোটো বেলা থেকেই বেশ পরিচিতো। তারই স্মার্ট ভার্সন প্রথম এই এপিসোড। অন্যসব এপিসোডের থেকে এইটাতে ডিটেইলিং একটু বেশি পেয়েছি। শুরুতেই ঠাকুমার ঝুলির বই এর উপর ফোকাস, পেত্নী অ্যাটাকের সময় বই পরে গিয়ে যে পাতা উল্টে যায়, সেখানেও পেত্নীর আক্রমণের ছবি। একাকী ঘরে হোম অ্যালোনের পোস্টার এমনকি ম্যাচ বক্সটাও স্যালমন মাছ ব্রান্ডের। এছাড়া ঘর জুরে বাংলাদেশের পতাকা, মুক্তিযুদ্ধ, ইয়াহিয়া খানের ছবি, কিংবা বিপদে ‘বুক ফেরাবে না, বুকের কাজ পিঠ করতে পারেনা’ ডায়লগ, এসবের মধ্য দিয়েও দর্শক চাইলে কোনো মেটাফোর খুঁজে নিতে পারে, সেই সুযোগও নুহাশ রেখেছেন৷

গল্পের শুরু হয় তিন বন্ধুকে গল্প শোনানোর মধ্য দিয়ে, শেষও হয় তাদের দিয়ে। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং হলো, যিনি গল্প শোনাচ্ছিলেন ঘটনাটা তারই জীবন থেকে নেয়া। শেষটা নিয়ে অনেকে ধোয়াশায় আছেন, যদিও আমার কাছে খুবই স্পষ্ট লেগেছে৷ হরর গল্পের মধ্যে সাটল রোমান্টিক গল্পও প্রকাশ পেয়েছে এখানে। হাসান পালাতে গিয়েও পালাতে পারেনি, শেষের দিকে পেত্নীর এক্সপ্রেশনে হিংস্রতার বদলে মায়া ছিলো। সম্ভবত এই মায়াতেই বাঁধা পরেছিলো হাসান। শেষে যখন বলে বউ আজ ডিনারে মাছ রান্না করেছে তখন বুঝতে বাকি থাকে না সেই পেত্নীর সাথেই এখন তার সংসার। এমনকি শেষে বন্ধুর নাকের রক্তের কারনে বউ তার পেত্নী ভার্সনে ফিরে যায়, তখন দেখা যায় তার আঙুলে বিয়ের আংটি। শেষে লীলাবালি গানটাও একই ইংগিত করে।

মিষ্টি কিছু

সবচেয়ে পছন্দের এপিসোড। এটি রিলিজ হবার আগেই পোস্টারটা দেখেই দারুণ চমক খেয়েছিলাম। এত সুন্দর পোস্টার আমাদের দেশে!! এপিসোডটা দেখে বুঝলাম সুন্দরের পাশাপাশি পোস্টারটা বেশ মিনিংফুল। জ্বীন মাহমুদের মাথায় মিষ্টি প্রতীকে স্মৃতি দিয়ে দিচ্ছে, এভাবেও ভাবা যায় কিন্তু। এই এপিসোডের বিশেষ দিক এটা মাহমুদ ক্যারেক্টারটির পাশাপাশি দর্শকদের মস্তিষ্কেও আঘাত করে৷ আসলেই যদি এমন হতো যে আমরা সমস্ত স্মৃতি, সব রহস্য জানতে পারতাম!! মাতৃগর্ভে আমাদের স্মৃতি, মহাবিশ্ব স্মৃষ্টির শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ঘটা সব ঘটনা যদি আমাদের মেমরি সেলে কেউ দিয়ে দিতো!! সেটা কি নিতে পারতাম আমরা!! সবজান্তা হবার পর কি হতো আমাদের!

নুহাশ হুমায়ূনের ‘ষ’

হাতে স্যাবাটিক গোট চিহ্নিত লাঠি, চা টগবগিয়ে ফুটে ওঠা বা আঙ্গুল দিয়ে সিগারেট ধরানোর মধ্য দিয়ে মনে রাখার মত একটা জ্বীন ক্যারেক্টার ক্রিয়েট করেছে নুহাশ। এছাড়াও আয়নার মধ্যে জ্বীনের প্রতিবিম্বের ভিন্ন এক্সপ্রেশন বা গর্ভের বাচ্চার মত কুন্ডলী পাকিয়ে থাকা মাহমুদ ভিন্ন এক মাত্রা দিয়েছে। আর শেষের দিকে মিষ্টি দিয়ে দেয়ালে গ্যালাক্সি আঁকার দৃশ্যটা! বাপরে! এই এক দৃশ্যর জন্যই নুহাশকে কয়েকবার স্যালুট দেয়া যায়। সায়েন্স, ফিলোসোফি, সাইকোলজি, মিথোলজি- সবকিছু মিষ্টি আর মিষ্টির রসে মিলে মিশে একাকার।

লোকে বলে

সবগুলা এপিসোডের মধ্যে সবচেয়ে ম্যাচিউর কাজ লেগেছে লোকে বলে। এরকম ভয় লাগানো মিউজিক ইন্টারন্যাশনালি এক্লেইমড হরর মিউজিক গুলার সাথে তুলনার যোগ্য। শুধুমাত্র ক্ল্যাইম্যাক্স দিয়ে দর্শকদের মজা দেখাবো টাইপ টিপিকাল ভাবনাতে নুহাশ যায়নি। শুরুতেই পানিতে মোবাইল খুঁজতে গিয়ে চুল খুজে পাওয়া দিয়েই ইঙ্গিত দিয়েছেন কি ঘটতে যাচ্ছে। শেষের লোক-কথাটা দিয়ে আগের প্রতিটা কুসংস্কার গল্প কানেক্ট করাকে দুর্দান্ত লেগেছে আমার কাছে। এছাড়া পুতুলের মধ্য দিয়ে ঘটনা গুলাকে বর্ণনা করাটাও চমৎকার ছিলো। আর্টিস্টদের পারফরম্যান্স বিবেচনায় এই এপিটা একটু পিছিয়ে থাকবে। তবে সব কিছু ছাপিয়ে বাচ্চা ছেলেটা মুগ্ধ করবেই। শেষের দিকে তার নাচ এবং গাছে পা ঝুলিয়ে বসে থাকার দৃশ্য মনে থাকবে অনেকদিন। এটায় চমৎকার একটা ডায়লগ আছে, ‘দোষের থেইকা বিচার বেশি’- যা আজকাল অহরহ হচ্ছে আমাদের সমাজে।

নিশির ডাক

চারটি এপিসোডের মধ্যে নিশির ডাকের কনসেপ্টটা আমার জন্য জেনুইনলি ভয়ের ছিলো। কারন নিজেরও একাকী অবস্থায় মাঝেমধ্যে মনে হয় কেউ ডাকছে, অদ্ভুত এক আকর্ষন অনুভূত হয়। তবে এপিসোডটা দেখে মনে হয়েছে, এই কনসেপ্টে আরো একটু বেটার কিছু হতে পারতো। হরর ছাপিয়ে মিস্ট্রি থ্রিলার বেশি হয়ে গেছে, খুন- গুম রহস্য। যদিও সেটাও উপভোগ করেছি। টক্সিক রিলেশনশিপের ডিপ্রেশন এবং এর ভয়াবহতাও উঠে এসেছে নিশির ডাকে। এই এপিসোডের সবচেয়ে চমৎকার বিষয় ছিলো ক্ল্যাইম্যাক্সে আগের তিনটা এপিসোডকে এক সুতায় গাঁথা। নিশির ডাকের মধ্যে এক ধরনের সিনেমাটিক ফিল পেয়েছি, যেটা খুবই আশাব্যঞ্জক।

চরকির এই অ্যান্থোলজি সিরিজ হরর জঁনরায় শুধু বাংলাদেশে না, বাংলা ভাষার সব কাজ গুলোর মধ্যেই এক বেঞ্চমার্ক হয়ে থাকবে। ‘ষ’ এর পুরো টিমকেই ধন্যবাদ । বর্তমানে প্রসংশা, মাতামাতির করার মত কাজ আমাদের দেশের নির্মাতারা তেমন একটা দেখাতে পারেন না। তবুও দিনশেষে সাদ, শাওকি, তৌকির এবং নুহাশদের কাজ দেখে মনে হয় আস্থা রাখার জায়গাটা শেষ হয়ে যায়নি এখনো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *