• June 15, 2025

Chalachchitra

Explore the magic of Bengali cinema and culture

শহীদুল ইসলাম খোকনের গল্প বলি

বাণিজ্যিক সিনেমা মানেই নাচ গান বা বাণিজ্যিক সিনেমা মানেই সেটা দেখে নাক সিটকাতে হবে – এই ধারণাটা আমাদের মাথায় বলতে গেলে অনেকটাই ‘সেট’ করা আছে। কিন্তু এই ধারণাকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে বাংলাদেশে যিনি একের পর এক অসাধারণ সিনেমা উপহার দিয়েছেন, তার নাম শহীদুল ইসলাম খোকন। তাকে নিয়ে লেখা শুরু করলে সেটা কোথায় শেষ হবে বলা কঠিন, তারপরেও চেষ্টা করছি তার সম্পর্কে যা জানি তা লেখার।

শহীদুল ইসলাম খোকন হচ্ছেন সেই পরিচালক যিনি ‘রক্তের বন্দি’ আর ‘পদ্মগোখরা’র মতো কম সফল সিনেমা দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করলেও তিন নাম্বার সিনেমা ‘লড়াকু’ দিয়ে বাজিমাত করেন। এই সিনেমা দিয়েই নায়ক হিসেবে নিজের ক্যারিয়ার শুরু করেন সোহেল রানার ভাই রুবেল। এই সিনেমাতে তিনি প্রথম মার্শাল আর্টকে প্রতিষ্ঠিত করেন বাংলা সিনেমাতে। ফলাফল- সিনেমা সুপারহিট। এই দেশের দর্শক যেন লুফে নিল এই নতুন ধরনের অ্যাকশনভিত্তিক সিনেমা। পাড়ায় পাড়ায় চলত মার্শাল আর্টের চর্চা।

শহদুল ইসলাম খোকন হচ্ছেন সেই পরিচালক যার একটি সিনেমা হলে চলার সময় বাইরে পুলিশের নিরাপত্তা ছিল আর হলে প্রতিটি দর্শককে চেক করে এরপরে ঢোকানো হচ্ছিল। সেই সিনেমার নাম ‘ঘাতক’। বাংলাদেশে আর কোন পরিচালকের সিনেমার বেলায় এমনটি ঘটেনি। এই সিনেমার কাহিনী এরকম ঘটনার কারণ। সোনার বাংলা নামে একটি ভবনে দুই ভাই বাস করতো, মুক্তিযুদ্ধের সময় যাদের মাঝে একজন যুদ্ধে যান (খলিল) আরেকজন পাকিস্তানী বাহিনির  সাথে হাত মেলান (হুমায়ূন ফরীদি)। কাকতালীয়ভাবে বা ইচ্ছাকৃতভাবে এই সিনেমাতে খলিলের গেটাপ ছিল জাতির জনক শেখ মুজিবর রহমানের মত (ব্যাকব্রাশ চুল আর মোটা ফ্রেমের চশমা) আর ফরীদিন লুক ছিল গোলাম আযমের মতো (সাদা দাড়ি আর জিন্নাহ টুপি)। এই কথা জানাজানি হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কারা যেন চিঠি পাঠায় যে এই সিনেমা হলে চালানো হলে সেই হল বোম দিয়ে উড়িয়ে দেয়া হবে। এই কারণেই এই সিনেমার ক্ষেত্রে এমনটা করা হয়েছিল।

শহীদুল ইসলাম খোকন হচ্ছেন সেই পরিচালক যিনি উড়ন্ত বিমানে লাইভ একশন দৃশ্য শুট করেছিলেন। যতদূর মনে পরে,সিনেমার নাম ছিল ‘বিপ্লব’। এই সিনেমার জন্য রুবেল মাথার চুল ফেলেছিলেন।এমনকি এই সিনেমাতে একটি দৃশ্যে রুবেল জ্যান্ত একটি ইঁদুরে কামড় দেন। (জি হ্যাঁ, শুধু হলি বা বলির নায়কেরা না, আমাদের নায়কেরাও একসময় এমন অনেক কিছু করেছেন একটা শুনলে আপনার চোখ এখন কপালে উঠবে)। এগুলো সব হয়েছিল নব্বই এর আমলে, আজকালের কথা না এগুলো।

রুবেল

শহীদুল ইসলাম খোকন হচ্ছেন সেই পরিচালক যিনি তার প্রতিটা সিনেমাতে নতুন কিছু হাজির করতেন দর্শকদের সামনে। সিনেমার শেষে সাধারণত পিতৃহত্যার প্রতিশোধ টাইপ ব্যাপার থাকলেও প্রতিটা সিনেমার প্লট একটার চেয়ে আরেকটা হত আলাদা। ‘বিশ্বপ্রেমিক’ নামক সিনেমাতে তিনি হাজির করলেন সাইকো কিলার ফরীদিকে, যিনি যেসব মেয়েদের গলায় তিল থাকে, তাদেরকে খুন করেন। খুন করার পরে সেই তিল ছুরি দিয়ে কাটেন, এরপরে আগে থেকে জমানো তিলের সাথে সেই তিল সেলাই করে গলার তিলের মালা বানান (!)। ‘শত্রু ভয়ঙ্কর’ সিনেমাতে তিনি এমন এক ফরীদিকে হাজির করেন যিনি খুন করলেও পুলিশ তাকে ধরতে পারেন না কারণ কোন প্রমাণ থাকে না। এর কারণ হিসেবে খোকন দেখিয়েছেন- ফরীদি বরফের ছুরি দিয়ে খুন করেন, খুন করার পরে রক্তের উত্তাপে বরফ গলে যায় ফলে মার্ডার ওয়েপন বা হাতের ছাপ কোনটাই পাওয়া যায়না। আমি জানি অনেকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না যে এগুলো কীভাবে বাংলা সিনেমার কাহিনী হয় বা আসলেই এরকম ছিল কিনা সেই নব্বইয়ের আমলে। বিশ্বাস না করলে ইউটিউবে দেখতে পারেন, প্রায় সবগুলো সিনেমাই পাবেন। এছাড়া ‘নরপিশাচ’ সিনেমাতে আমরা ফোল্ডিং সাইকেল (ভাঁজ করা যায় এমন সাইকেল যেটা ব্যাগে করা নিয়ে ঘোরা যায়!) দেখতে পাই যেটা সেই যুগে কল্পনা করাও দায়!

শহীদুল ইসলাম খোকন হচ্ছেন সেই পরিচালক যিনি আহমেদ সফার ‘ওঙ্কার’ উপন্যাস অবলম্বনে ‘বাংলা’ নামের একটি সিনেমা বানান যেটি তার কমফোর্ট জোন থেকে একেবারেই আলাদা। এরপরেও এই সিনেমাতে খোকন নিজের মুনশিয়ানার ছাপ রেখেছিলেন।

শহীদুল ইসলাম খোকন হচ্ছেন সেই পরিচালক যিনি ছোটপর্দার অনেক মানুষকে সিনেমাতে অভিনয় করিয়েছিলেন, তবে তার সেরা আবিষ্কার ছিল হুমায়ূন ফরীদি নামক হীরার খণ্ডকে সিনেমাতে আনা। ছোটপর্দার অভিনেতারা বড়পর্দায় তেমন কিছু করতে পারে না, এই ধারণাকেও ভুল প্রমাণ করেছিলেন খোকন, ফরীদির মাধ্যমে। ‘সন্ত্রাস’ সিনেমাতে অভিনয়ের মাধ্যমে খোকন আর ফরীদির যেই জুটি শুরু হয়েছিল, সেই জুটি অনেক সফল নায়ক-নায়িকার জুটিকেও হার মানায়। সাথে তো ছিলই রবেলের কুংফু। সিনেমা সব একের পর এক হিট। এমনও সময় গেছে, দর্শক যতটা নায়ক নায়িকাকে দেখতে আগ্রহী, তার চেয়ে বেশি আগ্রহী ছিল ফরীদিকে দেখতে।

শহীদুল ইসলাম খোকন হচ্ছেন সেই পরিচালক যিনি ‘পালাবি কোথায়’ নামক সিনেমার অর্থায়নের জন্য নিজের বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছিলেন। এই সিনেমাতে টাকা ঢালতে রাজি করিয়েছিলেন ফরীদিকেও। তবে সিনেমাটা ব্যবসা করতে পারেনি। ফরীদি নিজের বিনিয়োগ করা টাকা ফেরত নিলে, খোকনকে পুরো লোকসানের ভার বহন করতে হয়।

শহীদুল ইসলাম খোকন হচ্ছেন সেই পরিচালক যিনি ‘উত্থান পতন’ নামের সিনেমাতে নায়কের ক্যারেক্টারে অভিনয়ও করেছিলেন। তার অন্যান্য সিনেমার মতো এত সুপারহিট না হলেও এই সিনেমাটা ব্যবসাসফল ছিল। এরপরে আর কখনও কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় না করলেও, নিজের সিনেমাতে ছোট একটা ক্যারেক্টারে তিনি থাকতেনই। অনেকটাই অ্যালফ্রেড হিচককের মত। নাটকেও অভিনয় করেছিলেন।

শহীদুল ইসলাম খোকন হচ্ছেন সেই পরিচালক যিনি সিনেমার ইতিহাসে রেকর্ড পারিশ্রমিকপ্রাপ্ত পরিচালক ছিলেন। তার সিনেমার প্রযোজককে তিনি বলেছিলেন, আপনি শাবানাকে যত দিবেন, আমাকে তার চেয়ে দুই লাখ টাকা বেশি দিতে হবে। প্রযোজক জিজ্ঞেস করেছিলেন- কেন? তিনি বলেছিলেন- যেই শিল্পী আমার চেয়ে বেশি পারিশ্রমিক পাবে, সে অ্যাজ আ ডিরেক্টর আমাকে মূল্য দিবে না, আমার কথা শুনবে না আর এটার ফল ভাল হবে না। ফিল্ম ইজ অ্যাবসুলিউটলি ডিরেক্টরস মিডিয়া। এখানে ডিরেক্টরের অনুমতি ছাড়া একটা সুতাও নড়বে না।

শহীদুল ইসলাম খোকন হচ্ছেন সেই পরিচালক যিনি নায়ক নায়িকার রোম্যান্টিক গানে কোন এক্সট্রা শিল্পী থাকাকে নির্বুদ্ধিতার পরিচয় বলে গণ্য করতেন। নায়ক-নায়িকার প্রেম হলে সেখানে শুধু নায়ক বা নায়িকাই থাকবে, তাদের কোন সখা বা সখী থাকবে না- এটাই ছিল তার বিশ্বাস।

শহীদুল ইসলাম খোকন হচ্ছেন সেই পরিচালক যাকে তার সমালোচকেরা যখন বলেছিল- রুবেল ছাড়া খোকন অচল, তার সিনেমা চলবে না- তখন তিনি ইলিয়াস কাঞ্চনকে নিয়ে ‘কমান্ডার’ সিনেমা বানান, সাথে ফরীদি তো ছিলই। মজার ব্যাপার হল সবা সমালোচকের মুখে ছাই দিয়ে এই সিনেমাও ব্যবসাসফল হয়।

শহীদুল ইসলাম খোকন হচ্ছেন সেই পরিচালক যার কমেডি-অ্যাকশন সিনেমা ভন্ড মুক্তির পর সারাদেশে সব প্রেক্ষাগৃহে ২৯ শো টানা হাউসফুল হয়েছিলো।

শহীদুল ইসলাম খোকন হচ্ছেন সেই পরিচালক যিনি সিনেমাতে অশ্লীলতার বিরোধী আন্দোলনের সোচ্চার কণ্ঠ ছিলেন। শুধু কথাই বলেননি অশ্লীলতার বিপক্ষে, কাজেও প্রমাণ দেখিয়েছেন। ‘যোদ্ধা’ নামের একটি সিনেমা ছিল খোকনের, যেই সিনেমার পোস্টারে কোন ছবি ছিল না। শুধু উপরে লেখা ছিল ‘যোদ্ধা’ আর বাকি সব জায়গা লাল রং দিয়ে ভর্তি। নিচে এক কোনায় ছোট্ট করে লেখা- পোস্টারে অশ্লীল ছবির ব্যবহারের বিপক্ষে নিজের সিনেমার পোস্টারে কোন ছবি না দিয়ে অশ্লীলতার বিরুদ্ধে এটা আমার প্রতিবাদ।

শহীদুল ইসলাম খোকন হচ্ছেন সেই পরিচালক যিনি দুই বাংলার সিনেমার বিনিময়ে কখনও না করেননি। তবে তার শর্ত ছিল আগে আমাদের দেশের চ্যানেল পাশের দেশে মিনিমাম এক বছর চালাতে হবে, এরপরে সিনেমার বিনিময় হবে। এই সম্পর্কে তিনি বলেন- ‘আমার বাসার কাজের বুয়াও আপনার দেশের শাহরুখ খানকে চিনে, কিন্তু আপনার দেশের কয়জন আমাকে বা শাকিব খানকে চিনে? প্রতিবছর দুই হাজার কোটি টাকা চলে যায় এই চ্যানেলগুলোর জন্য। ভারতে আমাদের চ্যানেলগুলো চলছে না। ইন্ডিয়ার ভয় হচ্ছে, একটি চ্যানেল যদি তাদের দেশে চালাতে হয়, তাহলে ৫ কোটি রুপি ব্যাংকে দিতে হয়। আর আমাদের দেশে দিতে হয় এক লক্ষ টাকা। আগে আমার দেশের চ্যানেল চলবে, আমাদের চিনবে আপনাদের দর্শকেরা, এরপরে সিনেমা বিনিময়ে আমার কোন আপত্তি নাই। আর এই ক্ষেত্রে যদি কোন অনিয়ম হয়, তাহলে আমি আগুন জ্বালিয়ে দিব!’ এমনই প্রতিবাদী ছিলেন তিনি নিজের দেশের সিনেমার জন্য। তিনি আরও বলেন- ‘বাংলাদেশের সিনেমা আইনে সিনেমা হল করলে আপনি বছরে পনেরো পার্সেন্ট বিদেশি ছবি চালাতে পারবেন। সেভেন্টিফাইভ পার্সেন্ট ছবি বাংলা চালাতে হবে, লেখা আছে। এখন কিছু বলছি না এ কারণে যে, আগে হিন্দি থামাই পরে ইংরেজি ধরবো।’

শহীদুল ইসলাম খোকন হচ্ছেন সেই পরিচালক যিনি ইন্ডাস্ট্রিতে অনেক নতুন তারকাকে এনেছেন আর প্রতিষ্ঠিত করেছেন। রুবেল, তামান্না, সিমলা, ড্যানি সিডাক, ইলিয়াস কোবরা, সিরাজ পান্না, মিশেলা ও অ্যালেকজান্ডার বো। এর মাঝে মিশেলা ছিলেন কুংফু জানা একমাত্র অভিনেত্রী। নতুন আর্টিস্ট পরিচয় করানো সম্পর্কে তিনি বলেন- “একটা আর্টিস্টকে পর্দায় প্রথমে পরিচিত করাতে হয়। রুবেলকে যখন আনি তখন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেই- শক্তিশালী, স্বপ্নিল সুদর্শন নায়কের আবির্ভাব, ১৬ মিনিটের, নতুন শিল্পীর আবির্ভাব ড্যানি সিডাক- এই প্রেজেন্টেশনগুলা নাই। সিমলাকে আনার আগে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে তার নাম আহ্বান করি। হাজার হাজার নাম আসে। এর মধ্যে ১৪ জন নাম দিয়েছিলেন সিমলা। যার মধ্যে একজনকে লটারি গিফট করে টেলিভিশন গিফট করেছি আমি। এই যে প্রচারটা, নাইতো। এই যে নতুন শিল্পী আসছে তারা জনগণের কাছে তারা পৌঁছাতে পারছে না, কেননা তাদের প্রচার নাই। টেলিভিশন রেডিওতে এদের পাবলিসিটি নাই। মনে করেন, আমি যখন তামান্নাকে আনলাম, তখন টিভিতে বিজ্ঞাপন করলাম, ‘লোকে বলে সুন্দরী, আমি বলি সুন্দরী আহা, আসছে শহীদুল ইসলাম খোকনের নতুন নায়িকা তামান্না’। তারপর থেকে রাস্তায় নামলে লোকজন জমে যেতো।”

সিনেমা হলের সংখ্যা কমে যাওয়া সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন- ‘সিনেমা হলের আইন আছে একটা। সিনেমা হলের জন্য জমিন নিলেন, কিন্তু সিনেমা হল এখন ভেঙে দিলেন, কিন্তু এটা আপনি পারেন না। আইনে নেই। পৃথিবীর কোনো দেশে সরকারি সিনেমা হল ভাঙার সিস্টেম নেই। দেশে ১২০০ সিনেমা হল ছিল, এখন আছে ৩০০। তারা কি সরকারের অনুমতি নিয়েছিল? অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা আরেকটা যুক্ত হয়েছে বিনোদন। সিনেমা হল ঠিক করুক, একটা ছেলেও মদ খাবে না, গাঁজা খাবে না। প্রেমিকা নিয়ে সিনেমা দেখতে যাবে। গভমেন্ট এটা বোঝে না?’

শহীদুল ইসলাম খোকন হচ্ছেন সেই পরিচালক যিনি দর্শকদের পালস বুঝতে পারতেন, যিনি বাইরের দেশের সিনেমার খোঁজখবর রাখতেন। নতুন দিনের পরিচালকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন- ‘আমার সকল পরিচালক ভাইদের বলবো বই পড়ুন, অন্তত প্রতিদিন তিন ঘণ্টা বই পড়ুন। দয়া করে বই পড়ুন। তা না হলে বিশ্বের চলচ্চিত্র সম্পর্কে, সমাজ ও যুগ সম্পর্কে জানবেন কী করে? একজন মেথরের বেডরুম থেকে শুরু করে রাজার বেডরুম কেমন হয়, তা একজন পরিচালককে জানতে হবে। ফিল্ম ইজ অ্যাবসুলিউটলি ডিরেক্টরস মিডিয়া।’

একটি সিনেমাতে কী থাকলে মানুষ সিনেমাটি দেখবে এই সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে খোকন বলেছিলেন- ‘পরিচালকদের প্রথমেই জানতে হবে, সিনেমা তিনটি কারণে চলে: প্রথমটি, তোমার ছবিতে এমন কিছু আছে, যা দর্শক আগে কখনো দেখেনি। এমন কোনো কনসেপ্ট যেটা দুনিয়াতে এই প্রথম। দ্বিতীয়টি, তোমার ছবি দর্শকহৃদয় স্পর্শ করবে। কোনো না কোনো একটা দৃশ্য বা কোনো একটা সংলাপ বা কোনো একটা ক্যারেক্টারের আবেগ। তৃতীয়টি, হল থেকে বের হওয়ার পরও দর্শকের চোখে দৃশ্যগুলো ভাসবে এমন কিছু যেন তোমার সিনেমাতে থাকে।’

খোকন কথা বলেছেন এই দেশের সেন্সর বোর্ড সম্পর্কেও- “দেশের কোনো শিল্পমাধ্যমে কিন্তু সেন্সর নেই, শুধু সিনেমায় আছে। স্বাধীন দেশে স্বাধীনতা নেই শুধু চলচ্চিত্রকারদের। আমরা সব কথা বলতে পারি না। নাটকে আছে? টেলিভিশনে আছে? আমাদের কেন থাকবে? আমরা কি অচ্ছুৎ বাংলাদেশে? ‘ঘাতক’ সিনেমাতে আমার নিজের কিছু সংলাপ ছিল দেশদ্রোহীদের বিরুদ্ধে- যেটা সেন্সর কেটে দেয়।”

খোকনের মৃত্যুতে আমরা শুধু একজন পরিচালককে হারাইনি, আমরা এমন একজনকে হারিয়েছি- যিনি সিনেমা জিনিসটা বুঝতেন। তিনি বুঝতেন আমাদের সমস্যাটা কোথায়। নতুনদের সবসময় উৎসাহ দিতেন। তাদের সম্পর্কে বলতেন- ‘বেশ কিছু শিক্ষিত উদ্যোমী তরুণ আসছে নির্মাণে। তাদের আইডিয়া ভালো, চিন্তা-ভাবনা ভিন্ন এবং ভালো। খারাপ দিকটি হচ্ছে, ডিজিটাল ফরম্যাট হয়ে যাওয়ার পর কিছু লোক নাটক বানিয়ে তাতে দুইটা গান ঢুকিয়ে সিনেমা হিসেবে চালানোর চেষ্টা করছে। আমি ঘাবড়াই না এ জন্য যে, অনেকগুলো খারাপের মাঝে একটা ভালো হবেই। পৃথিবীর সবদেশেই খারাপ ভালো সবধরনের ছবিই হয়।’

এত নিরাশার মাঝেই যেই মানুষটা আশা দেখতেন, সেই আশাবাদী মানুষটাই ছিলেন ক্ষণজন্মা। আশাবাদী মানুষদের সম্ভবত খুব বেশিদিন বাঁচার অধিকার নেই এই দেশে। বর্তমান প্রজন্ম ভাবতেও পারবে না তারা যেই হলিউড আর বলিউড এর অনেক কিছু দেখে অবাক হয়, তার চেয়েও অবাক করা বিষয় আমাদেরকে শহীদুল ইসলাম খোকন দেখিয়েছেন সেই নব্বইয়ের আমলে। সীমিত পরিসরে, কম বাজেটে যতটা দেখানো যায়- ততটাই দেখিয়েছেন তিনি, চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখেননি। সিমলা যখন ‘ম্যাডাম ফুলি’ সিনেমার প্রথম শট দিতে যাবে, তখন সে জিজ্ঞাসা করে- ‘খোকন ভাই, ক্যামেরা কোথায়? আমি তো দেখতে পারছি না, কোনদিকে তাকিয়ে শট দিব?’ খোকন বলেন- ‘ক্যামেরা কোথায় সেটা তোমাকে জানতে হবে না, দেখতে হবে না, ক্যামেরাই তোমাকে খুঁজে নিবে।’

এরকম গুণী আর সাহসী নির্মাতা একবারই আসে। আর আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা তাকে হারিয়ে ফেলি। আমার অন্যতম প্রিয় পরিচালক শহীদুল ইসলাম খোকনের আত্মার শান্তি কামনা করছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *