মোসাদ (Mossad), যা ইসরায়েলের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা হিসাবে পরিচিত, বিশ্বজুড়ে তাদের গোপন ও জটিল অভিযানগুলির জন্য প্রসিদ্ধ। মোসাদকে সাধারণত একটি গোপন সংস্থা হিসেবে মনে করা হয়, যা নির্দিষ্ট কোনো কাজের জন্য প্রকাশ্যে পরিচিত না হলেও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা অভিযান পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইসরায়েলের এই সংস্থা তাদের জাতীয় সুরক্ষায় তথ্য সংগ্রহ, প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের হত্যা এবং বুদ্ধি যোগানের ক্ষেত্রে অসাধারণ কার্যক্ষমতার জন্য বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত। এই প্রবন্ধে মোসাদের কার্যক্রম, তাদের ইতিহাস, উল্লেখযোগ্য অভিযান এবং কৌশলগত কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
মোসাদের ইতিহাস ও প্রতিষ্ঠা
১৯৪৯ সালে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার এক বছরের মধ্যে মোসাদ গঠিত হয়। ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পরেই এই অঞ্চলের নিরাপত্তা নিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। ফলে গোয়েন্দা সংস্থার গুরুত্ব দ্রুতই বৃদ্ধি পায় এবং ১৯৫১ সালে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-গুরিয়ন এর অধীনে মোসাদকে গঠন করা হয়। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী মোসাদের প্রধান নিয়োগ করেন এবং দেশটির নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনায় এটি প্রধান ভূমিকা পালন করে।
মোসাদের উল্লেখযোগ্য অভিযানের তালিকা
মোসাদের কার্যক্রমের মধ্যে অনেক আলোচিত অভিযান রয়েছে, যা সংস্থাটিকে বিশ্বের অন্যতম সক্রিয় ও শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। নীচে মোসাদের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য অভিযান তুলে ধরা হলো:
১. অপেরেশন এনটেবে (Entebbe)
১৯৭৬ সালে ইউগান্ডায় একটি বিমান ছিনতাইয়ের পর, মোসাদ এবং ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী মিলে অপেরেশন এনটেবে পরিচালনা করে। জার্মান এবং প্যালেস্টাইনি সন্ত্রাসীদের দ্বারা আটককৃত ইসরায়েলি ও ইহুদি যাত্রীদের উদ্ধারে এই অভিযান পরিচালিত হয়। মোসাদের গোপন তথ্য ও কৌশলগত পরিকল্পনার সাহায্যে, ইসরায়েলি বাহিনী সফলভাবে অপারেশনটি সম্পন্ন করে এবং বেশিরভাগ যাত্রীকে উদ্ধার করে।
২. অপেরেশন রেথ অব গড (Wrath of God)
১৯৭২ সালে মিউনিখ অলিম্পিকের সময়ে ইসরায়েলি খেলোয়াড়দের হত্যার প্রতিশোধ হিসেবে মোসাদ “রেথ অব গড” নামে একটি গোপন অভিযান শুরু করে। এই অভিযানে তারা “ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর” দলের সদস্যদের একটি তালিকা তৈরি করে এবং তাদের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযান চালায়। এই অভিযানটি প্রায় দুই দশক ধরে চলে এবং বিভিন্ন দেশে মোসাদ অভিযান পরিচালনা করে।
৩. অপেরেশন ডায়মন্ড
মোসাদ তাদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা বাড়াতে বহু দুঃসাহসিক অভিযান চালিয়েছে। এর মধ্যে অপেরেশন ডায়মন্ড একটি উল্লেখযোগ্য অভিযান, যেখানে তারা ইরাক থেকে একটি রাশিয়ান মিগ-২১ যুদ্ধবিমান চুরি করতে সক্ষম হয়। ১৯৬৬ সালে ইরাকি পাইলটকে ইসরায়েলে আশ্রয় দেওয়ার শর্তে যুদ্ধবিমানটি ইসরায়েলে নিয়ে আসা হয়। এই বিমানের প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করে ইসরায়েল বিমান প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নতি করতে সক্ষম হয়।
৪. ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যা অভিযান
ইরান পরমাণু অস্ত্র উন্নয়ন নিয়ে কাজ করছিল, যা ইসরায়েলের জন্য এক বড় হুমকি ছিল। ইরানের বেশ কয়েকজন পরমাণু বিজ্ঞানীর রহস্যজনক মৃত্যু ঘটে, যাদের হত্যার পেছনে মোসাদের হাত থাকার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মহলে গুঞ্জন ওঠে। যদিও ইসরায়েল কখনোই এই ঘটনায় সরাসরি জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেনি, তবে বিভিন্ন সূত্রে ইঙ্গিত দেওয়া হয় যে, ইরানকে প্রতিরোধ করতেই মোসাদ এই ধরনের অভিযান পরিচালনা করেছে।
৫. অপেরেশন মোসেস ও অপেরেশন সলোমন
মোসাদের আরেকটি আলোচিত অভিযান হল আফ্রিকান ইহুদিদের উদ্ধার। ১৯৮০ এর দশকে অপারেশন মোসেস ও ১৯৯১ সালে অপারেশন সলোমন পরিচালনার মাধ্যমে আফ্রিকার ইথিওপিয়া থেকে ইহুদিদের ইসরায়েলে এনে আশ্রয় দেওয়া হয়। এই অভিযানগুলোতে মোসাদ গোপনভাবে সমুদ্রপথ ও বিমানপথ ব্যবহার করে হাজারো ইহুদিকে ইসরায়েলে নিয়ে আসে। এই অভিযান ইহুদিদের প্রতি মোসাদের মানবিক অবদানের একটি অন্যতম উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত।
মোসাদের কৌশল ও কার্যপ্রণালী
মোসাদের কার্যপ্রণালী অত্যন্ত গোপনীয় এবং তারা প্রায়ই নিজেদের এজেন্টদের বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে দিয়ে কাজ করে থাকে। তাদের কার্যপ্রণালীতে অত্যন্ত দক্ষ ও প্রশিক্ষিত ব্যক্তিদের ব্যবহৃত হয়, যারা প্রয়োজন অনুযায়ী ছদ্মবেশ ধারণ করে এবং গোপন মিশন চালায়। মোসাদের আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হলো:
- গোপন তথ্য সংগ্রহ: আন্তর্জাতিকভাবে ছড়িয়ে থাকা এজেন্টদের মাধ্যমে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করা।
- নির্দেশিত হত্যা: দেশের সুরক্ষায় হুমকি সৃষ্টিকারী ব্যক্তিত্বদের গোপনে হত্যা করা।
- প্রকল্প বিশ্লেষণ ও ভবিষ্যদ্বাণী: বিভিন্ন দেশের নিরাপত্তা এবং রাজনৈতিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে দেশের জন্য হুমকি বিবেচনা করা।
সমালোচনা ও বিতর্ক
মোসাদ বিভিন্ন সময়ে তাদের অভিযানগুলো নিয়ে বিতর্কের মুখোমুখি হয়েছে। তাদের বিভিন্ন হত্যাকাণ্ড এবং গোপন অভিযানের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে নিন্দিত হতে হয়েছে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন, নির্দিষ্ট ব্যক্তিত্বদের হত্যা এবং সন্ত্রাসবাদ বিরোধী অভিযানে তাদের হিংস্র কার্যপ্রণালী নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
মোসাদ ইসরায়েলের জাতীয় সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে এবং দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলির মধ্যে অন্যতম হিসাবে বিশ্বজুড়ে পরিচিতি লাভ করেছে। তবে তাদের অভিযানগুলো অনেক সময় বৈশ্বিক রাজনীতির ক্ষেত্রেও আলোচিত বিষয় হয়ে ওঠে। মোসাদ তাদের নিজস্ব কার্যপ্রণালী ও সুরক্ষার জন্য নিজস্ব পথে কাজ করে, যা তাদের কার্যক্ষমতাকে বিশেষভাবে আলাদা করে।