মারি অঁতোয়ানেত সিন্ড্রোম টি ‘ক্যানিটিস সুবিতা’ নামেও পরিচিত। এই রোগটি ভুতুরে এবং খুবই বিরল। এই রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তির মাথা বা শরীরের চুল হঠাৎ নাটকীয়ভাবে অল্প সময়ের মধ্যে সাদা হয়ে যায়।
এই বিরল ও অদ্ভুতুরে রোগটির নামকরণ করা হয়েছে ফরাসি রাণী মারি অঁতোয়ানেতের নামানুসারে। রাণীর চুল অতিরিক্ত মানসিক দুশ্চিন্তার ফলে রাতারাতি সাদা রঙে পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। এমনকি ইতিহাস গভেষকরাও এই হঠাৎ পরীবর্তের জন্য চরম মানসিক ধাক্কা, শোক এবং যন্ত্রণাকেই দায়ী করেন।
আজ অনেক ডাক্তারই মূলত সন্দেহ পোষণ করেন যে এটি মানবদেহের রাসায়নিক পদার্থের কারণে এই পরিবর্তন সৃষ্টি হতে পারে। অনেক চিকিৎসক এখনো শতাব্দী ধরে এর কারনগুলা খুঁজে পাওয়ার জন্য এখনো পরীক্ষা নিরীক্ষা করে যাচ্ছেন।
যাই হোক ১৮০০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত সর্বমোট ৮৪ জনকে আকষ্মিকভাবে চুল সাদা হয়ে যাওয়ার ঘটনা মেডিকেলের ইতিহাসে রেকড রয়েছে।
সিন্ড্রোমের নামকরণ করা হয় মারি অঁতোয়ানেতের নামে
১৭৫৫ সালে অস্ট্রিয়ায় মারি অঁতোয়ানেতের জন্ম হয়েছিল। এর ঠিক ১৫ বছর পরে, ১৭৭০ সালে তিনি ফ্রান্সের প্রিন্স লুইকে বিয়ে করেছিলেন, যিনি পরবর্তীতে ফরাসি সিংহাসনের উত্তরাধিকারী ছিলেন। ১৭৭৪ সালে তরুণ এই দুই দম্পতি ফ্রান্সের রাজা ও রাণী হয়েছিলেন।
মারি অঁতোয়ানেত প্রথমদিকে ফ্রান্সে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি একজন রাজকীয় সোশ্যালাইট ছিলেন যিনি পার্টি, নাচ এবং জুয়া উপভোগ করতেন এবং তার অসামান্য ডিজাইনের পোশাক ফ্রান্সের অন্যান্য উঁচুশ্রেণীর মহিলাদের মধ্যে ফ্যাশন ট্রেন্ডের সৃষ্টি হয়েছিল।
ফ্রন্সের রাজা রাণীদের অতিরিক্ত বিলাসবহুল জীবন ও রাজকর্মকর্তাদের অতিরিক্ত দূর্নীতির কারনে ক্ষুধা আর কষ্টে সাধারণ মানুষ ক্ষেপে উঠে। আর সেই ক্ষুধা থেকে সৃষ্টি হয় জগৎবিখ্যাত ফরাসি বিপ্লবের।
হঠাৎই ঘটে যাওয়া ফরাসি বিপ্লব রাণী মারি অঁতোয়ানেতের জীবন পাল্টে দেয়। ফরাসী বিপ্লব সফল হলে বিদ্রোহীরা ফ্রান্স সম্রাট ও তাদের রাণীকে বন্দী করেন। বিদ্রোহীদের হাতে ধরা পড়ার আগে রাজা লুই ষোড়শ, একজন পরিচায়কের পোশাক পরে ছদ্মবেশে প্যারিস থেকে পালানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন।

১৭৯৩ সালের ১৫ই জানুয়ারি বিদ্রোহীরা রাজা লুইকে বিচারের মুখোমুখি করেন। বিচারে রাজা লুইকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। এর ঠিক ৬ দিন পর রাজার মাথা শিরশ্ছেদ করে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়।
১৭৯৩ সালের অক্টোবর মাসে মারি অঁতোয়ানেত এর বিচার করা হয়েছিল। বিচারের সময় রাণীর চেহারা দেখে দর্শক হতবাক হয়ে যায়। কিছু বছর আগেও যার রাজকীয় চাকচিক্যে সাধারণ মানুষের মাথা ঘুরে যেতো, আজ তার এ কি হাল! দীর্ঘ আড়াই বছর জেলে থাকার ফলে রাণী মারি অঁতোয়ানেত এর চুল ধূসর সাদা হয়ে গিয়েছিল এবং তার গালগুলি শুকিয়ে হাড়ের ভিতরে ঢুকে গিয়েছিল।

বিচারে রাণী মারি অঁতোয়ানেত কেও তার স্বামী লুই এর মতোই মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেওয়া হয়। যেদিন মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছিল, মৃত্যুদন্ডের ঠিক আগ মুহূর্তে উপস্থিত সাধারণ জনতা চিৎকার করে তাদের সাবেক রাণীকে ঠাট্টা বিদ্রুপ করে। এরপর জল্লাদ তার বিশাল তরবারি দিয়ে রাণীর শিরশ্ছেদ করেন। রক্তের চারপাশ ভেসে যায়, আর সেই সাথে রাণীর মৃত্যু নিশ্চিত হয়।
মারি অঁতোয়ানেতকে জীবিত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন ছিলেন তার পরিচায়ক ‘হেনরিয়েট ক্যাম্পম্যান’, তার লেখা একটি বিবরণে বলা হয়:-
পালাতে গিয়ে বিদ্রোহীদের হাতে ধরা পড়ার পরে আমি রাণীর মধ্যে অদ্ভুত পরিবর্তন দেখতে পাই। তিনি আমার সামনে তার মাথার টুপি খুললেন আর চুলগুলোকে মনে হলো ধূসর সাদা রঙের মতো লাগছে।
ইতিহাসে এমন আরো কিছু ঘটনা
মারি অঁতোয়ানেতের অনেক আগ থেকেই এমন ঘটনা রেকড রয়েছে মেডিকেল হিস্ট্রিতে। প্রতিবারই এই ঘটনার জন্য অতিরিক্ত কষ্ট বা মানসিক চাপকে দায়ী করা করা হয়। এমনকি এই ঘটনার পেছনে বেশি বয়স কিংবা কম বয়স কোনো ভূমিকা পালন করে না, এমনটা অল্প বয়সীদের ও ঘটেছে।
১৬ শতকে স্কটল্যান্ডের ক্ষমতায় ছিলেন স্কট অব মেরি কুইন। আর ইংল্যান্ডের ক্ষমতায় ছিলেন রাণী প্রথম এলিজাবেথ। সম্পর্কে তারা দু’জন ছিলেন একে অপরের কাজিন। ইংল্যান্ডের ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের লোকজন ম্যারি স্কটের সাথে মিলে এলিজাবেথের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে শুরু করে ক্ষমতা দখলের জন্য। রাণী এলিজাবেথ ম্যারিকে শিরশ্ছেদ করে মৃত্যুদন্ডের শাস্তি দেন। মৃত্যুর আগে ম্যারি কুইনের চুলের রঙ একদম সাদা হয়ে গিয়েছিল।
ইতিহাস আমাদের আরো বলেন যে স্যার টমাস মোরও একই ধরনের পরিণতি ভোগ করেছিলেন। ইংল্যান্ডে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আগে তার চুল সাদা হয়ে গিয়েছিল। মৃত্যুদন্ডের কারণ ছিলো তিনি রাজার রাজকোষ থেকে অতিরিক্ত অর্থ খরচের সমালোচনা করতেন।