• June 24, 2025

Chalachchitra

Explore the magic of Bengali cinema and culture

বাংলা সিনেমার সোনালি যুগ: ১৯৫০-১৯৭০ সালের চলচ্চিত্রে কি ছিল বিশেষ?

ByDidarul Islam Himel

Nov 9, 2024

বাংলা সিনেমার সোনালি যুগ (১৯৫০-১৯৭০) একটি বিশেষ সময়কাল, যখন বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পটি এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছিল। এই সময়ের সিনেমাগুলিতে ছিল একটি গভীর শিল্পকৌশল, সাংস্কৃতিক গুরুত্ব, এবং সমাজের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির এক অনন্য মেলবন্ধন। এই যুগে বাংলা সিনেমার উৎপত্তি, বিকাশ এবং বৈশ্বিক পরিসরে তার প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। বাংলা সিনেমা বিশেষত ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে শিল্পমাধ্যম হিসেবে অনেক কিছু অর্জন করেছিল—একদিকে যেমন ছিল সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠতা, তেমনি ছিল নতুন ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রয়াস।

এই সময়কালটি একদিকে যেমন পরিচালকদের বিশেষত্ব ও দৃঢ়তা মেটানোর সময় ছিল, অন্যদিকে তেমনি চলচ্চিত্র শিল্পের ভেতর নতুন ধরনের ভাবনা, প্রযুক্তি এবং এক নিখুঁত শৈল্পিক প্রয়োগের সময়ও ছিল। বাংলা সিনেমার সোনালি যুগ ছিল শুধু প্রযুক্তির অগ্রগতির নয়, বরং সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পরিবর্তনেরও সাক্ষী। এই সময়কালে এমন কিছু চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছিল, যেগুলি শুধু বাংলা সিনেমার ইতিহাসে নয়, পৃথিবীজুড়ে চলচ্চিত্রের শিল্পকলার ইতিহাসে এক মাইলফলক হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।

১. প্রেক্ষাপট: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী যুগ

বাংলা সিনেমার সোনালি যুগের সূচনা ১৯৫০-এর দশকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী বিশ্বে এক নতুন রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা সৃষ্টি হয়, এবং এর প্রভাব পড়েছিল চলচ্চিত্র শিল্পেও। বিশেষত, ভারতীয় উপমহাদেশে নতুন জাতিরাষ্ট্রের জন্ম, ভাষার আন্দোলন, স্বাধীনতার পরবর্তী সামাজিক বিশৃঙ্খলা, এবং ভারত-পাকিস্তান বিভাজন—এই সবই বাংলা সিনেমায় প্রতিফলিত হতে শুরু করেছিল।

বিশ্বযুদ্ধের পরে প্রযুক্তির উন্নতি, চলচ্চিত্র তৈরির জন্য নতুন উৎসের সন্ধান এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি পেয়েছিল। বাংলা সিনেমা তখন আরও বেশি শিল্পমুখী, চিন্তাশীল এবং বাস্তবধর্মী হতে শুরু করেছিল। একদিকে যেমন ছিল অতিরিক্ত বাণিজ্যিক সফলতার চ্যালেঞ্জ, অন্যদিকে তেমনি চলচ্চিত্র নির্মাতারা স্বাধীনভাবে নিজের চিন্তাভাবনা প্রকাশ করার সুযোগ পেয়েছিলেন।

২. সত্যজিৎ রায়ের আগমন এবং চলচ্চিত্রের নতুন ধারা

১৯৫০ সালের পর বাংলা সিনেমার এক অন্যতম সেরা অধ্যায় শুরু হয় সত্যজিৎ রায়ের আগমনের মাধ্যমে। সত্যজিৎ রায়ের নাম শোনা মাত্রই মনে পড়ে যায় সেই অসামান্য ছবিগুলির কথা, যেগুলি শুধু ভারতীয় নয়, বরং আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র জগতেও ব্যাপক সম্মান অর্জন করেছিল।

সত্যজিৎ রায়ের “পথের পাঁচালী” (১৯৫৫) বাংলা সিনেমার নতুন একটি দিগন্ত উন্মোচন করেছিল। এই ছবি মুক্তির পর বাংলা সিনেমায় এক নতুন প্রবাহ শুরু হয়—একটি শিল্পকলার ধারা, যেখানে চিত্রনাট্য, দৃশ্যায়ন, সংগীত এবং চরিত্রের গভীরতার দিকে আলোকপাত করা হয়েছিল। রায়ের পরিচালনায়, বাংলা সিনেমায় প্রথমবারের মতো যে নিঃসঙ্গতা এবং শৈল্পিক প্রকাশ পেয়েছিল, তা ছিল এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। পথের পাঁচালী ছিল সাহিত্যের প্রভাব এবং ভারতের কৃষক শ্রেণির জীবনযাত্রার অনুপ্রেরণায় নির্মিত।

রায়ের অন্যান্য কাজগুলো যেমন “অপুর সংসার” (১৯৫৯), “রাজর্ষি” (১৯৬০) এবং “চিদম্বর” (১৯৬৭) বাংলা সিনেমার দর্শকদের মধ্যে এক নতুন চেতনার জন্ম দেয়। তিনি প্রচলিত রোমান্টিক বা রাজনৈতিক সিনেমার বাইরেও বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ের উপর আলোকপাত করেছিলেন। তাঁর সিনেমায় সর্বদাই ছিল সেই বিশেষ সৃজনশীলতা যা বাংলা সিনেমার ইতিহাসে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

৩. ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্রকর্ম এবং সমাজচেতনা

ঋত্বিক ঘটকও বাংলা সিনেমার সোনালি যুগের এক অপরিহার্য অংশ। তাঁর চলচ্চিত্রে সমাজ, দেশপ্রেম, নিপীড়িত মানুষের কষ্ট, বিভাজন, আর একাত্মতার যে গভীর চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তা ছিল অত্যন্ত তীব্র ও প্রভাবশালী। তাঁর সেরা কাজ “মেঘে ঢাকা তারা” (১৯৬০), “কবি” (১৯৫৮), “জীবননদী” (১৯৭০) প্রভৃতি বাংলা সিনেমার অন্যতম সেরা সৃষ্টি হিসেবে গণ্য হয়।

ঋত্বিক ঘটক তাঁর ছবিগুলিতে সাধারণ মানুষের দুঃখ, সংগ্রাম এবং সংগ্রামী জীবনকে তুলে ধরেছিলেন। চলচ্চিত্রে শোষিত, অবহেলিত মানুষের কষ্ট এবং তাদের আত্মবিশ্বাসের গল্প ছিল তাঁর প্রধান থিম। বিশেষত, “মেঘে ঢাকা তারা” এর মতো সিনেমা, যেখানে দেশভাগের পরে শরণার্থী জীবনের অশান্তি ও চ্যালেঞ্জ উঠে আসে, তা বাংলা সিনেমার ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে একটি চিরকালীন শ্রেষ্ঠ কাজ হিসেবে বিবেচিত।

৪. মৃণাল সেন এবং নতুন সিনেমা

মৃণাল সেনের “নীল আকাশের নীচে” (১৯৬৫) এবং “ভুবন সোম” (১৯৬৯) বাংলা সিনেমায় আধুনিকতার এক নতুন ধারা নিয়ে আসে। সেন তাঁর সিনেমায় রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতাকে তুলে ধরেছিলেন, এবং বাংলার পুরানো সামাজিক কাঠামো ও সমাজের অসঙ্গতি নিয়ে তাঁর প্রশ্নগুলো তোলার চেষ্টা করেছিলেন। মৃণাল সেন বাংলা সিনেমার অন্যতম শ্রেষ্ঠ পরিচালক, যিনি মনস্তাত্ত্বিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক বাস্তবতার বিষয় নিয়ে সাহসীভাবে কাজ করেছেন।

তিনি নিজে “নতুন সিনেমা” নামক এক আন্দোলন শুরু করেছিলেন, যা বাংলা চলচ্চিত্রের মধ্যে একটা নতুন ধরনের চিন্তাভাবনা এবং সৃজনশীলতা এনে দেয়। এই আন্দোলনটি ছিল প্রথাগত বাংলা সিনেমার এক বিরোধিতা, যেখানে রোমান্টিকতা বা সামাজিক গল্পের বাইরে আসা হয়েছিল। তাঁর পরিচালনায়, দর্শকরা কখনও এক সিনেমার মধ্যে সামাজিক সমালোচনা, কখনও আবার একটি রাজনৈতিক বক্তব্য পেতেন।

৫. চলচ্চিত্রের অভিনয় শিল্পী ও শিল্পীসাধনা

এই সময়কালটা ছিল বাংলা সিনেমার অভিনয় শিল্পীদের জন্যও এক নতুন দিগন্ত উন্মোচনের সময়। বিশেষত উত্তম কুমার, সুচিত্রা সেন, মাধবী মুখার্জী, রত্না ঘোষ, শর্মিলা ঠাকুর, এবং অন্যান্য একাধিক অভিনেতা-অভিনেত্রীরা তাঁদের দুর্দান্ত অভিনয় দিয়ে বাংলা সিনেমাকে বিশেষ মর্যাদা অর্জন করিয়েছিলেন।

উত্তম কুমার বাংলা চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বড় অভিনেতা হিসেবে পরিচিত। তাঁর অভিনয় ছিল এক কথায় অনন্য। তাঁর অভিনীত ছবি যেমন “সপ্তপদী” (১৯৬১), “দত্ত বাড়ির মেয়ে” (১৯৬৪), “অগ্নিপরীক্ষা” (১৯৬৫) ইত্যাদি বাংলা সিনেমায় জীবন্ত এক নতুন মাত্রা সৃষ্টি করেছিল। উত্তম কুমারের অভিনয়ে স্নিগ্ধতা, রোমান্টিসিজম এবং একই সঙ্গে গভীরতা ছিল যা তাঁকে একটি কিংবদন্তি অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।

এছাড়া সুচিত্রা সেন তাঁর অমর অভিনয় দিয়ে বাংলা সিনেমায় এক অমূল্য দান রেখেছিলেন। তাঁর সিনেমাগুলির মধ্যে “সপ্তপদী”, “অগ্নিপরীক্ষা” এবং “প্রতিদ্বন্দ্বী” (১৯৬১) অন্যতম। সুচিত্রা সেনের অভিনয় ছিল সুক্ষ্ম এবং সূক্ষ্মতার মধ্যে গভীরতা, যা বাংলা সিনেমার জন্য এক অনবদ্য উপহার।

৬. বাংলা সিনেমার বৈশ্বিক অভ্যর্থনা

বাংলা সিনেমার সোনালি যুগের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল এর বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা। সত্যজিৎ রায়ের “পথের পাঁচালী” (১৯৫৫), “অপুর সংসার” (১৯৫৯) এবং অন্যান্য চলচ্চিত্র আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছিল। সেই সময়কার পরিচালকরা, বিশেষত সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক এবং মৃণাল সেন, চলচ্চিত্র শিল্পের বৃহত্তর বিশ্বে ভারতীয় সিনেমার অবস্থান মজবুত করেছিলেন।

১৯৫৬ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে সত্যজিৎ রায়ের “পথের পাঁচালী” জাতিগত এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে ভারতীয় সিনেমার প্রতি বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে দিয়েছিল। তাঁর এই কাজ বিশ্ব চলচ্চিত্রে স্থান পেয়েছিল এবং রায়ের পরিচালক হিসেবে জনপ্রিয়তা এবং প্রশংসা বৃদ্ধি পেয়েছিল।

১৯৫০-১৯৭০ সালের বাংলা সিনেমার সোনালি যুগ ছিল একটি বৈপ্লবিক সময়কাল। এটি ছিল চলচ্চিত্রের শৈল্পিক উৎকর্ষতা, সমাজের প্রতি অনুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি এবং নানান ধরনের চিন্তাভাবনা প্রকাশের যুগ। এই সময়ের ছবিগুলিতে ছিল জীবন, সমাজ, রাজনীতি, এবং সাংস্কৃতিক দিকের একটি মেলবন্ধন, যা আজও বাংলা সিনেমার ইতিহাসে একটি অমূল্য ধন হিসেবে বিবেচিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *