১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল ইতিহাসের এক মহাকাব্যিক অধ্যায়। এই সংগ্রামের প্রতিটি দিন জুড়ে ছিল সাহস, ত্যাগ, ও বীরত্ব। তবে, যুদ্ধের অনেক ঘটনা এখনও সাধারণ আলোচনায় উঠে আসে না, অনেক অসাধারণ মানুষ রয়েছেন যাঁদের অবদান যথাযথভাবে স্বীকৃত হয়নি। এই লেখায় আমরা তেমন কিছু কম আলোচিত ঘটনা ও ব্যক্তিত্বের কথা তুলে ধরবো।
মহল্লাভিত্তিক প্রতিরোধ বাহিনী: স্থানীয় পর্যায়ের অগ্রণী সৈনিকরা
ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন শহরে যুদ্ধ শুরুর পর সাধারণ জনগণের একাংশ নিজ উদ্যোগে প্রতিরোধ বাহিনী গঠন করে। ঢাকার জিগাতলা, রাজারবাগ, কিংবা গুলশানে ছোট ছোট প্রতিরোধ দল গড়ে ওঠে, যারা শহর ছেড়ে যাওয়ার আগেই পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। এদের অনেকেই পরে মুক্তিযুদ্ধের মূল সেনাদলে যোগ দেন, তবে তাঁদের প্রথম দফার প্রতিরোধ যুদ্ধ প্রায়শই আলোচনা থেকে বাদ পড়ে যায়।
রেডিওর নেপথ্যের সংগ্রাম: বেতারে বিপ্লব
পাকিস্তানি সেনারা যখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ধ্বংস করতে চেয়েছিল, তখন গোপনে বেশ কিছু তরুণ কণ্ঠসৈনিক ও প্রযুক্তিবিদ নিরবিচারে কাজ করে যাচ্ছিলেন। জহুর আহমেদ, শহীদুল্লাহ কায়সারসহ অনেকেই প্রচার চালানোর জন্য বিকল্প জায়গা খুঁজে বের করেছিলেন। যুদ্ধকালীন সময়ে স্বাধীন বাংলা বেতারের বীরত্বপূর্ণ প্রচেষ্টা মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল দৃঢ় করতে বড় ভূমিকা রেখেছিল।
‘গেরিলা’ চিকিৎসকরা: অজ্ঞাতনামা জীবনরক্ষক
মুক্তিযুদ্ধের সময় শুধু গেরিলা বাহিনী নয়, কিছু চিকিৎসকও গেরিলা কৌশলে কাজ করছিলেন। বেলুন ফেলে আহতদের সেবা দিচ্ছিলেন, গোপনে ঔষধ সরবরাহ করছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, ডা. আলতাফ হোসেন গোপন হাসপাতাল চালিয়ে প্রায় দুই হাজার মুক্তিযোদ্ধার চিকিৎসা করেছিলেন, যার কথা খুব কম আলোচিত হয়।
নারীদের গুপ্তচরবৃত্তি: সাইলেন্ট ফাইটাররা
মুক্তিযুদ্ধে নারীদের শুধু সহযোদ্ধা হিসেবেই নয়, গুপ্তচর হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। অনেক নারী তাঁদের পরিচয় গোপন রেখে পাকিস্তানি বাহিনীর চলাচল, পরিকল্পনা এবং আক্রমণের তথ্য সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের সরবরাহ করেছেন। ফরিদপুরের রোকেয়া বেগম কিংবা খুলনার রাশিদা আখতারদের মত কিছু সাহসী নারী জীবন বাজি রেখে এই কাজ করেছেন।
রেড ক্রসের ছদ্মবেশে মুক্তিযুদ্ধের সহায়তা
আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলোর অন্তরালে কিছু মুক্তিযোদ্ধা লুকিয়ে কাজ করছিলেন। তাঁরা আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করছিলেন, গোপনে অস্ত্র সরবরাহ করছিলেন, এবং পাকিস্তানি সেনাদের দৃষ্টি এড়িয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছিলেন। এই সাহসী মানুষদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ডা. আবদুল হালিম, যিনি যুদ্ধক্ষেত্রের কাছাকাছি রেড ক্রসের ইউনিট পরিচালনা করতেন এবং গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করতেন।
উপসংহার
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের অনেক অপ্রকাশিত অধ্যায় আজও আমাদের জানার বাকি। ইতিহাসের মূলধারার বাইরে থেকে যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, তাঁদের স্মরণ করা আমাদের দায়িত্ব। আমাদের গবেষণা ও আলোচনা যত গভীর হবে, ততই আমরা নতুন নতুন বীরদের আবিষ্কার করব, তাঁদের ত্যাগের গল্প আমাদের নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে পারব।