• June 23, 2025

Chalachchitra

Explore the magic of Bengali cinema and culture

বাংলাদেশি সিনেমার বিবর্তন: ক্লাসিক হিট থেকে আধুনিক ব্লকবাস্টার

ByDidarul Islam Himel

Nov 12, 2024

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প, বা ঢালিউড, তার জন্মলগ্ন থেকে আজকের আধুনিক ডিজিটাল যুগে পৌঁছানোর পেছনে অনেক পথ পাড়ি দিয়েছে। এই দীর্ঘ যাত্রায় বহু চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে গেছে, তবে এতে নানা পরিবর্তন এবং উন্নতির ছোঁয়া লেগেছে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রগুলো একসময় যেখানে ছিলো মূলত কাহিনী-নির্ভর ও সমাজবিষয়ক, সেখানে আজ নতুন প্রযুক্তি, ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট, এবং ভিন্নধর্মী কাহিনী নিয়ে নতুন জোয়ার এসেছে। চলুন, একবার দেখে নেওয়া যাক বাংলাদেশের সিনেমার এই দীর্ঘ বিবর্তন।

শুরুটা কেমন ছিলো: ক্লাসিকের যুগ

১৯৫৬ সালে “মুখ ও মুখোশ” মুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশি সিনেমার পথচলা শুরু হয়। সে সময়ের সিনেমাগুলোতে গ্রামীণ জীবন, সামাজিক সমস্যা এবং সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখের চিত্র তুলে ধরা হতো। তৎকালীন সময়ে পরিচালক জহির রায়হান এর মতো কিংবদন্তিরা এমন কিছু সিনেমা নির্মাণ করেন, যা আজও দর্শকদের মনে জায়গা করে আছে। “জীবন থেকে নেয়া,” “তিতাস একটি নদীর নাম,”“অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী” এর মতো চলচ্চিত্রগুলো এদেশের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ হয়ে গেছে।

কাহিনীভিত্তিক এবং মেলোড্রামাটিক এই সিনেমাগুলোর কেন্দ্রে থাকত পারিবারিক গল্প, পিতৃ-মাতৃবন্দনা, আর সমাজ সচেতনতার বার্তা। সাদা-কালো ফিল্মের মধ্যে থাকা এই গল্পগুলো সেই সময়ের দর্শকদের হৃদয়ে গভীরভাবে রেখাপাত করত।

সত্তরের দশক: মুক্তিযুদ্ধ ও বাস্তবধর্মী কাহিনী

সত্তরের দশকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তৈরি হওয়া চলচ্চিত্রগুলোতে দেখা গেছে দেশপ্রেম এবং স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা। “ওরা ১১ জন,” “আবার তোরা মানুষ হ,” “মেঘের অনেক রং” এর মতো সিনেমাগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের বিভিন্ন কাহিনী এবং দেশপ্রেমের বার্তা তুলে ধরা হয়। এই সময়কার সিনেমাগুলোতে আমাদের জাতীয় চেতনা ও সংগ্রামের প্রতিফলন ঘটেছে।

এ সময়ে নির্মাতারা বাস্তবধর্মী এবং সাহসী গল্পের ওপর জোর দেন। ফলে দর্শকরা সিনেমা হলে গিয়ে নিজের জীবনের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেতেন। এ সময়ের সিনেমাগুলোতে সমাজের নিম্নবিত্ত মানুষের জীবন, শহরের বিপ্লবী চরিত্র, এবং গ্রাম বাংলার গল্প ফুটে উঠেছিল।

নব্বইয়ের দশকে ঢালিউডের রঙিন যুগ এবং কমার্শিয়াল সিনেমার উত্থান

নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশি সিনেমায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে। এই সময়ে রঙিন চলচ্চিত্রের চাহিদা বাড়তে থাকে এবং টেকনোলজির ব্যবহার শুরু হয়। এর ফলে সিনেমাগুলো হয়ে ওঠে আরও আকর্ষণীয় এবং ভিজ্যুয়ালি রিচ। এ সময়ের সিনেমাগুলো মূলত গান, রোমান্স এবং মেলোড্রামায় ভরপুর ছিল, যা সাধারণ দর্শকদের বেশ আকর্ষণ করত।

“বেদের মেয়ে জোসনা,” “বিরাজ বউ,” “আশা ভালোবাসা,” “অনন্ত প্রেম,” ইত্যাদি সিনেমা দেশের বাজারে ব্লকবাস্টার হিট হিসেবে প্রমাণিত হয়। নায়ক-নায়িকার মারপিট, গান, এবং উত্তেজনাপূর্ণ কাহিনী এ সময়ে সিনেমার প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়। এই ধারায় নায়ক সালমান শাহ, মান্না, ও মৌসুমী-এর মতো তারকারা দর্শকদের মধ্যে দারুণ জনপ্রিয়তা লাভ করেন।

২০০০ সালের পরবর্তী সময়: কন্টেন্ট এবং গল্পের নতুন ধারা

২০০০ সালের পরের সময়ে বাংলাদেশি সিনেমা এক ধরনের স্থবিরতার মধ্যে পড়ে। দর্শকরা বিদেশি সিনেমা এবং টেলিভিশন ধারাবাহিকের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে, ফলে দেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি ভুগতে থাকে। তবে এই পরিস্থিতির মধ্যেই কিছু নির্মাতা নতুন ঘরানা এবং নতুন গল্প নিয়ে কাজ শুরু করেন।

“মেড ইন বাংলাদেশ,” “থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার,” “জয় যাত্রা ইত্যাদি সিনেমাগুলো ভিন্নধর্মী কাহিনী ও বাস্তবসম্মত বিষয়বস্তু নিয়ে কাজ করে দর্শকদের আকর্ষণ করতে শুরু করে।

এ সময়ে নির্মাতারা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের দিকে নজর দেন এবং কন্টেন্টের গুণগত মান উন্নত করার প্রয়াস চালান। ফলে সিনেমার গল্পের গুণগত মান বৃদ্ধি পায় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসা লাভ করে।

বর্তমান যুগ: ওটিটি বিপ্লব এবং ডিজিটাল রূপান্তর

বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি ডিজিটাল এবং ওটিটি (ওভার-দ্য-টপ) প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে নতুন জীবন পেয়েছে। নেটফ্লিক্স, হইচই, অ্যামাজন প্রাইম এর মতো প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশি কন্টেন্টের প্রবেশের ফলে বাংলাদেশের সিনেমা আজকের আন্তর্জাতিক দর্শকদের কাছেও পৌঁছে যাচ্ছে।

“ঊনপঞ্চাশ বাতাস,” “হাওয়া,” “শনিবার বিকেল,” “আইসক্রিম” এবং “ন ডরাই” এর মতো সিনেমাগুলো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এবং প্রেক্ষাগৃহ উভয় জায়গাতেই বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এই সময়ে সিনেমায় ক্যামেরা ও ভিজ্যুয়াল ইফেক্টের মান উন্নত হয়েছে, যা আগের থেকে অনেক উন্নত এবং আন্তর্জাতিক মানের।

আজকের আধুনিক ব্লকবাস্টার: গল্পে বৈচিত্র্য এবং নতুন চিত্রনাট্য

আধুনিক বাংলাদেশি সিনেমাগুলোতে দেখা যাচ্ছে সাহসী গল্প, এবং ভিন্ন ধাঁচের চরিত্র। এ সময়ের সিনেমাগুলোতেও মুক্তিযুদ্ধের গল্প আছে, তবে তা অন্যরকম আঙ্গিকে উপস্থাপিত। “মিশন এক্সট্রিম,” “পরাণ,” “দামাল” এর মতো সিনেমাগুলো শুধু থ্রিলার বা রোমান্সে আটকে নেই; বরং তাতে গল্প এবং প্রযুক্তির মিশেলে নতুন কিছু উপস্থাপন করা হয়েছে।

এই সব সিনেমাগুলোতেও গুণগত মান, দক্ষ অভিনেতা এবং নির্মাতাদের অবদানের ছোঁয়া পাওয়া যায়। আজকের বাংলাদেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি শুধু বিনোদন নয়, বরং সমাজের বিভিন্ন বিষয় এবং পরিবর্তনশীল জীবনধারার প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশি সিনেমার এই বিবর্তন এবং পরিবর্তন প্রমাণ করে যে আমাদের ইন্ডাস্ট্রি দিন দিন আরও পরিপক্ক এবং আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হয়ে উঠছে। পুরনো ক্লাসিক সিনেমাগুলো আমাদের ইতিহাস এবং সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে; আর আজকের আধুনিক ব্লকবাস্টার সিনেমাগুলো এই ইন্ডাস্ট্রির ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা দিচ্ছে। এই দীর্ঘ যাত্রায় সিনেমা আমাদের জীবন, সমাজ এবং সংস্কৃতির বিভিন্ন দিককে তুলে ধরেছে, যা বাঙালি দর্শকদের জন্য গর্বের বিষয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *