বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাস খুবই সমৃদ্ধ এবং দীর্ঘ। এই দীর্ঘ ইতিহাসে অগণিত চরিত্র উঠে এসেছে, তাদের মধ্যে কিছু চরিত্র এতটাই গভীরভাবে দর্শকের মনে প্রভাব ফেলেছে যে তারা এখন সঙ্গতভাবেই বাংলা সিনেমার অমূল্য রত্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সাধারণত, বাংলা সিনেমার সেরা চরিত্রগুলি যেগুলি চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকে, তা হলো তারা যারা কেবল ইতিবাচক (positive) নয়, বরং নেগেটিভ চরিত্রেও নিজের শক্তি ও আবেদন রেখে গেছেন।
নেগেটিভ চরিত্রের ধারণা নিয়ে সাধারণভাবে যে প্রতিক্রিয়া মানুষের মধ্যে চলে, তা বেশিরভাগ সময় নেতিবাচক—অর্থাৎ, যারা “খারাপ” কাজ করে, তারা সাধারণত দর্শকদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে থাকে না। তবে, বাংলা সিনেমার ক্ষেত্রে, নেগেটিভ চরিত্রকে গ্রহণ করার অর্থ কেবলমাত্র তাদের খারাপ আচরণ বা কর্মকাণ্ড নয়। বরং এই চরিত্রগুলি সিনেমার কাহিনিতে গভীরতা, নাটকীয়তা, উত্তেজনা, এবং এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসে। তারা সিনেমার সৃষ্টিতে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে, বিশেষ করে তাদের জটিল মনোবল, চরিত্রের গঠন, এবং অনন্য অভিনয়শৈলীর জন্য।
এই প্রবন্ধে, আমরা বাংলা চলচ্চিত্রের কিছু সেরা নেগেটিভ চরিত্রের দিকে মনোযোগ দেব এবং বিশ্লেষণ করব কেন তারা সিনেমার ইতিহাসে এত গুরুত্বপূর্ণ, তাদের আবেদন কী, এবং কিভাবে তাদের পারফরমেন্স দর্শকদের ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছে।
নেগেটিভ চরিত্রের বৈশিষ্ট্য
প্রথমেই আমরা একটু বুঝে নিই যে নেগেটিভ চরিত্র বলতে কী বোঝায়। সোজা ভাষায়, নেগেটিভ চরিত্র এমন একটি চরিত্র যারা মূলত সমাজ বা সমাজের অন্য চরিত্রদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকে, তারা সাধারণত অন্যদের ক্ষতি করতে চায়, বা তারা এমন কিছু কাজ করে যা নৈতিকভাবে ভুল বা বেআইনি। তবে, বাংলাসহ পৃথিবীজুড়ে সিনেমায়, নেগেটিভ চরিত্রগুলিকে শুধুমাত্র খারাপ হিসেবে দেখা হয় না। বরং, তারা অনেক সময় এমনভাবে নির্মিত হয়, যাতে দর্শক তাদের অনুভূতির মধ্যে এক ধরনের দ্বন্দ্ব অনুভব করতে পারে। কখনো কখনো, এই চরিত্রগুলোও দুঃখিত, বিপর্যস্ত, বা সঙ্গীন পরিস্থিতিতে পরিচালিত হতে পারে, যার ফলে তাদের দিকে সহানুভূতি জন্মায়।
যতটা না তারা খারাপ, তার থেকে বেশি তারা চমকপ্রদ, জটিল, এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে ইন্টারেস্টিং। একে বলা যায়—এক ধরনের “গ্রে ক্যারেক্টার”। এই চরিত্রগুলো সাধারণত তীক্ষ্ণ, বুদ্ধিদীপ্ত, এবং তাদের কর্মকাণ্ডে এক বিশেষ পরিকল্পনা থাকে, যা দর্শককে আকর্ষণ করে।
বাংলা সিনেমায় এমন কিছু নেগেটিভ চরিত্র তৈরি হয়েছে, যাদের চরিত্রের জটিলতা এবং অভিনয়ের গভীরতা এতটাই শক্তিশালী যে, তারা একসময় সিনেমার প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়ে, এবং কাহিনির প্রেক্ষাপটের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে।
বাংলা সিনেমায় সেরা নেগেটিভ চরিত্র
এখন আমরা কিছু সেরা নেগেটিভ চরিত্রের দিকে নজর দেব, যারা বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
১. বিক্রম (কাকাবাবু সিরিজ) – ফেরদৌস
সেই চরিত্রটির কথা বললেই দর্শক মনে পড়ে যায়, যিনি ‘কাকাবাবু’ সিরিজের একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নেগেটিভ চরিত্র—বিক্রম। কাকাবাবু সিনেমায় ফারুক শফিকের বিক্রম চরিত্রটি ছিল এক সত্যিকারের কৌশলী, নিখুঁত এবং শীতল মনের খলনায়ক। যা মূলত, কাকাবাবু চরিত্রটির জন্য এক বিপদ তৈরি করেছিল। তার চরিত্রের আচরণ প্রাথমিকভাবে তেমন কেমন ছিল না, কিন্তু সিরিজের পরবর্তী পর্বে তার আসল চরিত্র একে একে বেরিয়ে আসতে থাকে।
বিক্রমের চরিত্রটি শুধুমাত্র ভয়ঙ্কর ছিল না, ছিল অসীম বুদ্ধিমত্তা, অত্যন্ত হিসেবী। সেই চরিত্রটির মধ্যে মানবিক দুর্বলতা এবং কৌশলগত সামর্থ্যও ছিল—যা দর্শককে এক গভীর এবং সুস্পষ্ট প্রতিক্রিয়ার দিকে ঠেলে দেয়। চরিত্রটির সাংঘাতিক দিকগুলো দর্শকদের কাছে উত্তেজনা এবং আগ্রহের সৃষ্টি করে, আর এই কারণেই বিক্রমের চরিত্রটি বাংলাসিনেমার অন্যতম শক্তিশালী নেগেটিভ চরিত্র হিসেবে চিহ্নিত।
২. জগাই ও মাধাই (সুবোধ) – দেবাশীষ
শিল্পী দেবাশীষের অভিনয় দক্ষতায় তৈরি সুবোধ সিনেমার দুজন খলনায়ক—জগাই এবং মাধাই। তাদের চরিত্রে এক বিপুল শক্তি, ভিলেন হিসেবে তাদের প্রচণ্ড অশান্তির ছাপ ছিল। এবং এক অসীম দুঃখদায়ক, দুর্বৃত্তদের চরিত্র গঠন করা হয়েছে, যাদের অনুশোচনা বা সংস্কার ভাবনা ছিল না। তারা সরাসরি অন্যদের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত, তবে সেসবই ছিল সিনেমার বিশেষ একটি চরিত্রের মূল উপাদান।
জগাই-মাধাই তাদের কুৎসিত আচরণ এবং আধিপত্যে দর্শককে একটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি উপহার দিয়েছে। তাদের অস্তিত্ব পুরো সিনেমাকে প্রবাহিত করে, এবং সেই আবেগের সঙ্গে দর্শকের নিজস্ব অনুভূতিও সম্পৃক্ত হয়ে যায়। ফলে, এই দুজনের ভূমিকা ছাড়া সিনেমা জমে ওঠেনি। তাদের অভিনয়ের শক্তি, চরিত্রের গভীরতা এবং সেই ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য আজও তাদের মধ্যে শ্রদ্ধা করা হয়।
৩. জুলফিকার (জুলি) – কুমার বিশ্বাস
জুলি সিনেমায় জুলফিকার চরিত্রটি এক নিখুঁত উদাহরণ। একজন অপরাধী ও মাফিয়া নেতার চরিত্রে কুমার বিশ্বাস এতটাই উৎকৃষ্ট অভিনয় করেছেন যে দর্শক তার প্রতি এক অস্বাভাবিকভাবে সহানুভূতিশীল হতে পারে। জুলফিকার তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি এবং কৌশলের মাধ্যমে সিনেমার কাহিনীকে চালিত করে, এবং তাকে কেন্দ্র করে সব কিছু ঘুরতে থাকে।
এই ধরনের নেগেটিভ চরিত্রগুলো যেন গল্পের মূল থিমকে দাঁড় করিয়ে দেয়, যেগুলির দ্বারা সিনেমার মূল পটভূমি এবং গল্পের প্রকৃতি চিত্রিত হয়। তাদের মনের মধ্যে এক অদ্ভুত শক্তি ছিল যা দর্শকের মনোযোগ বারবার তার দিকে টেনে আনে।
৪. রাজু (মেঘে ঢাকা তারা) – ঋত্বিক ঘটক
মেঘে ঢাকা তারা সিনেমার রাজু চরিত্রটি একটি অসাধারণ নেগেটিভ চরিত্রের উদাহরণ। এখানে রাজু একজন মানুষের দুর্বলতা এবং হতাশার চিত্রায়ন। তার চরিত্রের গভীরতা, তার জীবনযাত্রার নানা প্রতিবন্ধকতা এবং তার মধ্যে বিদ্যমান প্রেরণা খুবই সুনির্দিষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। রাজু, যিনি সিনেমার কাহিনির এক অনিশ্চিত চরিত্র, তাও এক অর্থে খলনায়ক হিসেবে আমাদের কাছে উপস্থিত।
রাজুর মাধ্যমে ঋত্বিক ঘটক বাঙালি দর্শকদের সামনে এক নতুন দৃষ্টিকোণ উপস্থাপন করেন। এমনকি তার চরিত্রের অন্ধকার দিকটি এমন একটি সামাজিক রাজনৈতিক দ্বন্দ্বকে তুলে ধরেছিল, যা তখনকার সমাজের জন্য এক গভীর প্রশ্ন ছিল।
৫. বিভাব (চিরকাল) – প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়
এই চরিত্রটি বাংলার সিনেমার ইতিহাসে এক অনন্য অবস্থান রাখে। চিরকাল সিনেমার বিভাব চরিত্রটি শুধুমাত্র খলনায়ক হিসেবে নয়, বরং এক সামাজিক ব্যাধি হিসেবে সমাজের মধ্যে প্রভাবিত এক শক্তিশালী চরিত্র ছিল। এই চরিত্রে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় অভিনয় করে দর্শকদের এক নতুন মানসিক অবস্থায় নিয়ে যান।
বিভাব চরিত্রটি সিনেমার প্রতিটি সেকেন্ডে নতুন নতুন প্রশ্ন উত্থাপন করে, যা দর্শককে কেবল তার আচরণ নয়, বরং তার মনোবিজ্ঞান এবং তার অন্তরীণ পরিস্থিতির দিকে চোখ রাখতে বাধ্য করে।
নেগেটিভ চরিত্রের আবেদন
নেগেটিভ চরিত্রের আবেদন হলো, তারা কখনো একেবারে “অসীম খারাপ” থাকে না, বরং তাদের মধ্যে এমন অনেক দিক থাকে যা দর্শককে অবচেতনভাবে তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে বাধ্য করে। তাদের চরিত্রের গভীরতা, মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা এবং ইতিহাস অনেক সময় সৃজনশীল দর্শকদের মনে অজানা উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। নেগেটিভ চরিত্রগুলি যখন একদম “ক্লাসিক” ধরনের, তখন তা চলচ্চিত্রের জন্য এমন এক ধরনের শক্তি এনে দেয়, যা একটি সিনেমাকে দীর্ঘকাল স্মরণীয় করে রাখতে সাহায্য করে।