• October 19, 2025

Chalachchitra

Explore the magic of Bengali cinema and culture

নারীকেন্দ্রিক যে চলচ্চিত্র অনুপ্রেরণার

ByDidarul Islam Himel

Mar 10, 2024

চলচ্চিত্রে নারীরা এসেছেন সাবলীলভাবেই। তবে কিছু কিছু ছবি আছে যা কথা বলেছেন শুধুই নারীকে কেন্দ্র করে। নায়িকা বা অভিনেত্রী হয়ে উঠেছেন ছবির মূল উপজীব্য। এদেশে হাতেগোনা নির্মাণ এসেছে নারীকে সামনে রেখে। হয়েছে প্রশংসিতও। তেমন কিছু চলচ্চিত্র নিয়ে আমাদের এ আয়োজন—

১. রূপবান (১৯৬৫) : নারীর ধৈর্য, ত্যাগ ও সংগ্রামের অনবদ্য এক চলচ্চিত্র এটি। পরিচালনা করেছেন সালাউদ্দিন। বলা হয়ে থাকে, ছবিটি ছিল প্রথম লোককাহিনীনির্ভর ও সুপারহিট চলচ্চিত্র। এতে কেন্দ্রীয় ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সুজাতা। রূপবান চরিত্রে অভিনয় করে রাতারাতি খ্যাতি পান তিনি। গানের জন্যও এই ছবি হয়েছিল তুমুল শ্রোতানন্দিত।

২. সারেং বউ (১৯৭৮) : শহীদুল্লাহ কায়সারের উপন্যাস অবলম্বনে এটি পরিচালনা করেন আবদুল্লাহ আল মামুন। এতে একাকী বধূর সংগ্রাম উঠে এসেছে। গ্রামের মোড়লের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন এর মূল চরিত্রে থাকা কবরী। এর জন্য তিনি পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ছবিতে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের এক নারীর জীবন সংগ্রাম স্থান পেয়েছে। এর গল্পটা এমন—কদম সারেং ভালোবেসে বিয়ে করে নবিতনকে। বিয়ের কিছুদিন পরে আবার চলে যান জাহাজে। কদম মাঝেমধ্যেই নবিতনের কাছে চিঠি ও টাকা পাঠায়। কিন্তু গ্রামের মোড়ল ডাক পিয়নকে হাত করে সেই সব নিয়ে নেয়। তিনি অভাবের সুযোগে নবিতনকে লালসার শিকার বানাতে চান। কিন্তু নবিতন ঢেঁকিতে ধান ভানার কাজ করে সংসার চালান। কোনোভাবে মোড়লের ফাঁদে পা দেন না। এভাবে এগিয়ে যায় কাহিনি। স্বামী ফিরে এলে ঘটনা মোড় নেয় অন্যদিকে। ফারুক-কবরী অভিনীত এই ছবিটিতে আব্দুল জব্বারের কণ্ঠে ‘ওরে নীল দরিয়া’ গানটি এখনো সমান জনপ্রিয়।

৩. গোলাপি এখন ট্রেনে (১৯৭৮) : এটিকে দেশের অন্যতম নারীকেন্দ্রিক ও সেরা বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। ছবিটি নিজের লেখা উপন্যাস অবলম্বনে আমজাদ হোসেন নির্মাণ করেন। এ সিনেমায় অভিনয় করেছেন ববিতা, ফারুক, আনোয়ার হোসেন, রোজী সামাদ, আনোয়ারা, এটিএম শামসুজ্জামান প্রমুখ। খেটে খাওয়া গ্রামীণ নারীর নানা বাধাবিপত্তি উঠে এসেছে এর গল্পে। কিন্তু দৃঢ়প্রত্যয়ী নারী নিজের মর্যাদাবোধ নিয়ে এগিয়ে চলেন। ছবিটি সেরা চলচ্চিত্রসহ মোট ১২টি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। ববিতার ক্যারিয়ারে এটি সেরা চলচ্চিত্র হিসেবে বিবেচিত হয়।

৪. সূর্য দীঘল বাড়ি (১৯৭৯) : আবু ইসহাকের ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত কালজয়ী উপন্যাস ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ অবলম্বনে এটি যৌথভাবে পরিচালনা করেছেন মসিহউদ্দিন শাকের ও শেখ নিয়ামত আলী। সিনেমাটি বাংলাদেশের প্রথম সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। ছবিটি সেরা চলচ্চিত্রসহ মোট ৬টি শাখায় জাতীয় পুরস্কার অর্জন করে। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অন্যতম শক্তিশালী নারী জয়গুন চরিত্রে ডলি আনোয়ারের অনবদ্য অভিনয় তাকে এনে দেয় জাতীয় পুরস্কার। আরো অভিনয় করেছেন রওশন জামিল, জহিরুল হক, আরিফুল হক, কেরামত মাওলা, এটিএম শামসুজ্জামান।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে অবিভক্ত ভারতের বাংলায় ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে ‘পঞ্চাশের আকাল’ নামে যে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল, সেই দুর্ভিক্ষে লাখো দরিদ্র মানুষ প্রাণ হারায়। যারা কোনোমতে শহরের লঙ্গরখানায় পাত পেতে বাঁচতে পেরেছিল তাদেরই একজন স্বামী পরিত্যক্ত জয়গুন। সঙ্গে তার মৃত প্রথম স্বামীর ঘরের ছেলে ও দ্বিতীয় স্বামীর ঘরের মেয়ে। আরও আছে মৃত ভাইয়ের স্ত্রী-পুত্র। তারা গ্রামে ফিরে এসে এমন একখণ্ড জমিতে ঘর তৈরি করে যেটি অপয়া ভিটে বলে পরিচিতি ছিল। দুর্ভিক্ষ, দরিদ্রতা, মাতৃত্ব সর্বোপরি এক নারীর জীবন সংগ্রামের দৃশ্য ফুটে উঠেছে এ চলচ্চিত্রে।

৫. ভাত দে (১৯৮৪) : আমজাদ হোসেনের আরো একিট মাস্টারপিস ধরা হয় এটিকে। আলমগীর, শাবানা, আনোয়ার হোসেন অভিনীত সিনেমাটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কার সহ মোট ৯টি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে। জরি চরিত্রে অভিনয় করে শাবানা তার সেরা চলচ্চিত্র দিয়ে ঘরে তুলে নেন জাতীয় পুরস্কার। এছাড়া বাংলা ছবির মধ্যে ‘ভাত দে’ প্রথম কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অংশ নেয়। এর গল্পটা এমন—জরি একজন গরিব বাউলের মেয়ে। ছোটবেলায় অভাবের কারণে মা চলে যায়। অন্ধ বাউল বাবার অভাব-অনটনের সংসারে সে বড় হতে থাকে। জরি যখন বড় হয়, একদিন বাবাও ভাত জোগাড় করতে গিয়ে মারা যায়। এর পর শুরু হয় সহায়-সম্বলহীন এক দরিদ্র নারীর জীবন সংগ্রাম। আসে প্রেম, অতঃপর করুণ পরিণতি।

৬. হাঙর নদী গ্রেনেড (১৯৯৭) : চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ছবির গল্প নেওয়া হয়েছে কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের উপন্যাস অবলম্বনে। এটি সরকারি অনুদানের সিনেমা। মুক্তিযুদ্ধে নারীর ত্যাগের অসাধারণ রুপায়ন এই চলচ্চিত্র। সুচরিতা, সোহেল রানা,অরুণা বিশ্বাস অভিনীত এই ছবিটি চারটি বিভাগে জাতীয় পুরস্কার অর্জন করে। বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম শক্তিশালী নারী চরিত্র বুড়ি চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় স্বরূপ জাতীয় পুরস্কার ঘরে তুলেন সুচরিতা। গল্পের কেন্দ্রে থাকে হলদি গাঁ আর সেই গ্রামের এককালের দস্যি মেয়ে বুড়ি। বয়সে অনেক বড় চাচাতো ভাই গফুরের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বিয়ের ফলে রাতারাতি গফুরের আগের পক্ষের দুই ছেলে সলিম ও কলিমের মা হয়ে যায়। বুড়ির কোলে আসে নিজের সন্তান রইস। কিন্তু আর ১০টি শিশুর মতো স্বাভাবিক নয়। ১৯৭১ সালে কিছু মুক্তিযোদ্ধাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের সন্তানকেই মুক্তিযোদ্ধা বলে পাকিস্তান আর্মিদের হাতে তুলে দেন।

৭. ম্যাডাম ফুলি (১৯৯৯) : এটি নির্মাণ করেন শহীদুল ইসলাম খোকন। এ ছবিতে অভিনয় করে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন সিমলা। তিনিই প্রথম অভিনেত্রী যিনি তার অভিষেক চলচ্চিত্রেই শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। এ ছবিটিও ছিল একটি নারীপ্রধান গল্পের।

৮. মোল্লা বাড়ির বউ (২০০৫) : পুরোপুরি কমেডি ঘরানার ছবি হলেও এটি ছিল ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে সোচ্চার নারীর গল্প। এতে নারীর অসহায়ত্ব ও নারীর লড়াইয়ের চিত্র সমান্তরালভাবে উঠে এসেছে। এটি পরিচালনা করেন সালাউদ্দিন লাভলু। ছবিতে অভিনয় করেছিলেন মৌসুমী, শাবনূর, রিয়াজ, এটিএম শামসুজ্জামান প্রমুখ। এই ছবিতে রিয়াজের দুই বউয়ের চরিত্রে দেখা যায় মৌসুমী ও শাবনূরকে। যারা ছিলেন ছবির গল্পের প্রাণ।

৯. নিরন্তর (২০০৬ ): হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস ‘জনম জনম’ থেকে ছবিটি তৈরি করেছেন আবু সাইয়ীদ। এর গল্পটা এমন—বাবার অন্ধত্বের কারণে তিথিদের পরিবারে আকস্মিক দুর্যোগ নেমে আসে। কোনো চাকরি জোগাড় করতে না পেরে তিথি অন্ধকার পথে পা বাড়ায়। এ ছাড়া বয়ে বেড়ায় শৈশবের নির্যাতনের স্মৃতি। ছোট ভাইয়ের ব্যবসায় এক সময় তিথিদের পরিবার সচ্ছলতা ফিরে পায়। তিথিও দেহব্যবসা ছেড়ে দেয়। কিন্তু তার জীবন দিন দিন ফ্যাকাসে হতে থাকে। কোথাও কথা বলার একজন মানুষ খুঁজে পায় না। শাবনূর, লিটু আনাম, ইলিয়াস কাঞ্চন, ডলি জহুর অভিনীত এ ছবিটি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মাননাসহ বাংলাদেশের হয়ে অস্কারে প্রতিনিধিত্ব করে। চিত্রনায়িকা শাবনূরের ক্যারিয়ারে এ ছবিটি অনন্য হয়ে থাকবে।

১০. খাইরুন সুন্দরী (২০০৭) : এ কে সোহেল পরিচালিত ‘খাইরুন সুন্দরী’। চিত্রনায়িকার মৌসুমীর অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র এটি। তাঁর স্বামীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন ফেরদৌস। এ ছবিটি রেকর্ড পরিমাণ ব্যবসা করে। একইসঙ্গে ছবিতে মমতাজের গাওয়া ‘খাইরুন লো…’ শিরোনামের গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। ছবির গল্পটি ছিল একজন নারীর প্রতি তার স্বামীর ভালোবাসা ও বিশ্বাস নিয়ে। গ্রামীণ নারীরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কেমন করে স্বামীর ভালোবাসাবঞ্চিত হয়ে করুণ পরিণতি বরণ করে নেয় তারই একটি গল্প ছিল এখানে। এ ছবিতে অনবদ্য অভিনয়ের জন্য মৌসুমী জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।

১১. গেরিলা ২০০৭) : প্রয়াত সৈয়দ শামসুল হকের ‘নিষিদ্ধ লোবান’ ও পরিচালকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে নির্মিত নাসিরউদ্দিন ইউসুফের চলচ্চিত্র ‘গেরিলা’। মুক্তিযুদ্ধ সময়কার গ্রামীণ ও শহুরের প্রেক্ষাপটে অপূর্ব সংমিশ্রণ এ ছবির প্রধান চরিত্র বিলকিস। সেও নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, দেশের জন্য নিজের জীবন দিয়ে দেয়। সরকারি অনুদানে নির্মিত অনন্য এ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রটি সেরা চলচ্চিত্রসহ মোট ১১টি বিভাগে জাতীয় পুরস্কার লাভ করে। বাংলা চলচ্চিত্রে অন্যতম শক্তিশালী নারী চরিত্র বিলকিস রূপদানদারী জয়া আহসান জিতে নেন জাতীয় পুরস্কার।

১২. অগ্নি (২০১৩) : এর মাধ্যমে বহুদিন পর নারীকেন্দ্রিক পুরো বাণিজ্যিক ছবি পান দর্শকরা। এতে কেন্দ্রীয় ভূমিকায় আছেন মাহিয়া মাহি। এ ছবির মাধ্যমেই প্রথমবারের মতো পুরোপুরি অ্যাকশনধর্মী নায়িকা হিসেবে দর্শকের সামনে আসেন তিনি। সিনেমায় তুলে ধরা হয় এক নারীর লড়াইয়ের গল্প। পরে ২০১৫ সালে ছবিটি সিক্যুয়েল তৈরি হয়।

১৩. সুতপার ঠিকানা (২০১৫) : নির্মাতা প্রসূন রহমানের সৃষ্টি এটি। সরকারি অনুদানে নির্মিত এ ছবিতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছে অপর্ণা ঘোষ। একজন নারীর শৈশব থেকে বার্ধক্য পুরো জীবন কাটে বাবা, স্বামী, সন্তানদের আশ্রয়ে। এর মাঝেও কিছু নারী নিজের ঠিকানা খুঁজতে চেষ্টা করে। তেমনিই এক নারী সুতপা। পুরো ছবি তিনি একাই টেনেছেন। কুমার বিশ্বজিতের সংগীতায়োজন ছিল প্রশংসনীয়, ধারা বর্ণনায় আসাদুজ্জামান নূর অন্যরকম আবহ সৃষ্টি করেছে। ছবিটি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কারও অর্জন করেছে।

১৪: ন ডরাই (২০১৯): নারীভিত্তিক এ চলচ্চিত্রটিতে নবাগতা সুনেরাহ বিনতে কামাল বেশ প্রশংসিত হন। শুধু নারীই নয়, এটি খেলাধুলাবিষয়কও অন্যতম চলচ্চিত্র। এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো পর্দায় উঠে আসে সার্ফিং। চিত্রনাট্য লিখেছেন শ্যামল সেনগুপ্ত, প্রযোজনা করেছেন মাহবুব রহমান এবং পরিচালনা করেছেন তানিম রহমান অংশু। চলচ্চিত্রটি এটি ৪৪তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ ৬টি বিভাগে পুরস্কৃত হয়।

এছাড়াও নায়িকাকেন্দ্রিক সিনেমা হিসেবে আছে ‘বিজলি’। পশ্চিমা ধাঁচের এ ছবিতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন ববি। ‘বিদ্রোহী পদ্মা’, ‘শাস্তি’, ‘সুভা’, ‘মায়ের অধিকার’, ‘তিন কন্যা’, ‘মেয়েরাও মানুষ’, ‘পালাবি কোথায়’, ‘মহুয়া সুন্দরী’, ‘বস্তির রানী সুরিয়া’, ‘সুন্দরী বধূ’, ‘মৌসুমী’, ‘চার সতীনের ঘর’, ‘রানী কেন ডাকাত’সহ বেশি কিছু ছবিতে নারীকে প্রধান হিসেবে পেয়েছে ঢাকাই চলচ্চিত্র।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *