• June 28, 2025

Chalachchitra

Explore the magic of Bengali cinema and culture

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শিশুদের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প: অনাহারে, তৃষ্ণায় ও অসুখে ভোগে মৃত্যু হতো শিশুদের

ByDidarul Islam Himel

Jan 9, 2024

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা শুনলে প্রথমেই মাথায় আসে নাৎসি বাহিনীর কথা। আর নাৎসি বাহিনীর বন্দী শিবিরে নির্যাতিত হওয়া লক্ষ লক্ষ মানুষের কথা।

বিশেষ করে আউশউইৎস কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের কথা প্রায়ই আমাদের মনে আসে। অন্যান্য কনসেনট্রেশন ক্যাম্পও ছিল, যেগুলো নাৎসি সহযোগীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

তবে সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল আধুনিক ক্রোয়েশিয়ার কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলো। এগুলো পরিচালনা করতেন উস্তাশে। উস্তাশে ছিল একটি উগ্র-জাতীয়তাবাদী এবং ফ্যাসিবাদী সংগঠন। আর তাদের পরিচালনা করতো নাৎসি নিয়ন্ত্রিত পুতুল সরকার।

উস্তাশে সার্বিয়ান, ইহুদি এবং রোমানিয়ানদের নির্মূল করতে উঠে পড়ে লেগেছিলো। আর তাই সেসব অঞ্চলের গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ধ্বংস করেছে। প্রাপ্তবয়স্কদের জীবন্ত জবাই করে হত্যা করা কিংবা গুলি করা হত্যা করা ছিলো মূল টার্গেট। যদি কারো কপাল একটু ভালো হতো তাহলে তার জায়গা হতো কোনো কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। সেখানে ধীরে ধীরে ধুঁকে ধুঁকে মরতে হতো তাদের।

সিসাক কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের ছবি Image source: Wikimedia Commons

আর সেখানকার নবজাতক থেকে চৌদ্দ বছর বয়সী বাচ্চাদের পিতামাতাদের থেকে আলাদা করে বন্দী শিবিরে পাঠিয়ে দিতো।
উস্তাশে কেবলমাত্র শিশুদের রাখার জন্য দুটো কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করেছিল।

আর সেখানকার নবজাতক থেকে চৌদ্দ বছর বয়সী বাচ্চাদের পিতামাতাদের থেকে আলাদা করে বন্দী শিবিরে পাঠিয়ে দিতো।
উস্তাশে কেবলমাত্র শিশুদের রাখার জন্য দুটো কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করেছিল।

বেশ কিছু জায়গায় উল্লেখ রয়েছে যে উস্তাশে রা নির্যাতনের ক্ষেত্রে নাৎসি বাহিনী অর্থাৎ নিজেদের গুরুকেই পাশবিকতায় হার মানিয়েছে।

১৯৪২ সালের ফেব্রুয়ারিতে উস্তাশে রা বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার বানজা লুকার কাছে সারগোভাক গ্রামে হামলা চালায় সেখানে তারা বুড়ো কিশোর থেকে থেকে নবজাত শিশু কাউকেই রেহাই দেয় নি, পশুর মতো গুলি করে হত্যা করেছে।

সিসাক কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে লাইনে দাঁড়িয়ে একদল শিশু Image: Wikimedia Commons

শুধুমাত্র সার্গোভাকের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়েই, উস্তাশে বায়ান্ন শিশুকে জবাই করে হত্যা করেছিল। উস্তাশে সদস্যদের মধ্যে একজন ছিলেন একজন রক্তপিপাসু ফ্রান্সিসকান ফ্রিয়ার যিনি সন্দেহাতীত স্কুলছাত্রীর গলা কেটেছিলেন এবং এইভাবে নৃশংস গণহত্যার সূত্রপাত করেছিলেন।

উস্তাশে ১৯৪২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই সারগোভাক এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামে প্রায় ৫০০ শিশুকে হত্যা করেছিল।

উস্তাশে রা সবসময়ই শিশুদের হত্যা করতো না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা শিশুর পিতা মাতা কে হত্যা করে শিশু কে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিতো।

উস্তাশের শিশুদের জন্য তৈরি প্রথম শিবিরটি ছিল ক্রোয়েশিয়ার রাজধানী জাগ্রেবের থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে সাঁইত্রিশ কিলোমিটার (তেইশ মাইল) দূরের জাস্ত্রেবারস্কো শহরে।

আর দ্বিতীয়টি ছিলো এই দুটো কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর। দ্বিতীয় কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প টি ছিল জাগরেবের দক্ষিণ-পূর্বে আটচল্লিশ কিলোমিটার দূরের (ত্রিশ মাইল) সিসাক শহরে।
শিশুদের জন্য কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলোকে বলা হতো শরণার্থীদের আশ্রয়কেন্দ্র।

সিসাক শহরের শিশু কনসেনট্রেশন ক্যাম্প

সিসাক শহরের শিশুদের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পটি ১৯৪২ সালের আগস্ট মাস থেকে ১৯৪৩ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত চালু ছিলো। এই কয়েক মাসে এই কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে প্রায় ৭০০০ শিশুকে রাখা হয়েছিলো। তারমধ্যে ১,৬০০ জন শিশুই অনাহার, তৃষ্ণা এবং আমাশয় এবং টাইফাসের মতো রোগে মারা গেছে।

কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে প্রবেশ করা একটি ডেথ ক্লাবে প্রবেশ করার মতোই ছিল যা শুধুমাত্র অনাচার এবং উন্মাদনা দ্বারা শাসিত হতো। সেখানে প্রতিটি মুহূর্ত আপনি কেবল চিৎকার, কান্না এবং হাহাকার শুনতে পাবেন।

ডোব্রিলা কুকলজ
(সিসাক কনসেনট্রেশন ক্যাম্প থেকে বেঁচে যাওয়া শিশুদের মধ্যে একজন।)

(Image: globalvoices.org)

ক্যাম্পের অবস্থা ছিল ভয়াবহ। শিশুরা পর্যাপ্ত খাবার পেতো না। তাদের ঘুমানোর জায়গা ছিলো মেঝে, মেঝেতে তারা পাতলা খড় বিছিয়ে ঘুমাতো। খাবার পানি ও অযত্নে থাকার ফলে শরীর দেখে মনে হতো কোনো জীবন্ত কঙ্কাল। এছাড়াও অনেক শিশু স্কার্ভি রোগে ভুগছিল ফলে তাদের দাঁত পড়ে যাচ্ছিল। প্রায়শই শিশু মারা যেতো। মৃত আর জীবিত প্রায় সকলেই মেঝেতে অর্ধ নগ্ন কিংবা সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে পড়ে থাকতো। এ এক বিভৎস দৃশ্য!
প্রতিদিন একজন কালো ইউনিফর্ম পড়া লোক ঠেলাগাড়ি নিয়ে এসে মৃত শিশুদের তুলে নিয়ে যেত।

শিশুদের প্রায়ই বিষাক্ত দুধ এবং গ্রিল খাওয়ানো হত এবং দ্রুত মারা যায়। ক্যাম্পের ডাক্তার, আন্টুন নাজার, ডাকনাম “ক্রোয়েশিয়ান মেঙ্গেল”, শিশুদের উপর চিকিৎসা পরীক্ষা চালান। প্রায়ই তাদের প্রাণঘাতী ইনজেকশন দিয়ে হত্যা করতেন। যুদ্ধের পরে, নাজারকে একটি ফায়ারিং স্কোয়াড দ্বারা মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।

(Image: secretgardening.wordpress.com)

জাস্ত্রেবারস্কোর শিশু কনসেনট্রেশন ক্যাম্প

জাস্ত্রেবারস্কো কনসেনট্রেশন ক্যাম্পটি ১৯৪২ সালের জুলাই মাস থেকে ১৯৪২ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত চালু ছিল। ক্যাম্পটি সেন্ট ভিনসেন্ট ডি পল অর্ডারের ডটারস অফ চ্যারিটির ননদের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। ক্যাম্পের কমান্ড্যান্ট ছিলেন সিস্টার বার্তা পুলহেরিজা। বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের মতে, সব শিশুই পুলহেরিজাকে ভয় করত।

নান রা শিশুদের অবহেলা করত এবং প্রায়শই তাদের লবণ এবং ভিনেগারে ডুবিয়ে বার্চের ডাল দিয়ে মারতেন।
এই কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে প্রায় ৩,৩০০ শিশু রাখা হয়েছিল। এর মধ্য প্রায় ১,৫০০ শিশুর মৃত্য হয়েছিল।

(Image: alo.rs)

শিশুদের মৃতদেহ কাঠের কফিনে রাখা হতো। যেহেতু কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে কফিন সংকট ছিলো তাই কফিকে শিশুদের মৃতদেহ কে চাপাচাপি করে এক কফিনে কয়েকটি লাশ রাখা হতো।

একবার এক গ্রাসিওজা নামের এক নান ক্যাম্পের কিছু শিশুকে এক সারিতে সোজা করে দাড় করিয়ে। এরপর তাদেরকে এক এক করে পিছ থেকে গলায় ছুঠি চালিয়ে নিমিষে প্রায় এক ডজন শিশু কে হত্যা করে ফেলেন!

— জোর্কা ডেলিক-স্কিবা, জাস্ত্রেবার্স্কো ক্যাম্প থেকে বেঁচে যাওয়া একজন শিশু

এছাড়া নিকটবর্তী রেকা গ্রামে জাস্ত্রেবারস্কোর সাব-ক্যাম্পে প্রায় ২,০০০ শিশু ছিল। রেকা ক্যাম্পের অবস্থা জাস্ত্রেবার্স্কোর থেকেও খারাপ ছিল। সেই শিবিরে কোনো পানি, বিদ্যুৎ বা স্যানিটেশন ও ছিল না।

এই পোস্টের ফিচার কভার ইমেজে যে ছেলেটিকে দেখতে পাচ্ছেন তার নাম মিলান বিজিচ। তার জন্মসাল ১৯৩৮। তিনি সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য সিসাক শিশুদের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে বন্দী ছিলেন। তিনি সেবার সেই কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন। তিনি এখনো জীবিত আছেন। বর্তমানে তিনি ক্রোয়েশিয়ার সিলাস নাম গ্রামে থাকেন।

যেহেতু ক্যাম্পে বন্দী হওয়ার সময় তার বয়স ছিল মাত্র চার বছর, তাই ছবির মেয়েটি কে ছিল তা তার মনে নেই।

মিলান বিজিচ (Image: Quora/@Jovana Raković)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *