• June 28, 2025

Chalachchitra

Explore the magic of Bengali cinema and culture

তারারে: পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষুধার্ত মানুষ; যিনি জীবন্ত কুকুর, বিড়াল এমনকি বাচ্চা শিশু খেয়েছিলেন

ByDidarul Islam Himel

Jan 5, 2024

তারারের জন্ম ১৭৭২ সালে ফ্রান্সের লিঁওর একটি ছোট মফস্বল শহরে। তারারে যে সময়টায় জন্মেছিলেন তখন ফরাসি বিদ্রোহ চলছিলো পুরোদমে।

তারারে কুকুর, বিড়াল থেকে শুরু করে যে কোনো প্রাণী জীবন্ত গিলে ফেলতে পারতো। শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি কিশোর বয়সেই প্রতিদিন প্রায় একটি ষাঁড়ের চারভাগের একভাগ খেয়ে ফেলতো তারারে, যা ছিলো প্রায় তার ওজনের সমান। এমন অদ্ভুত ও অপ্রত্যাশিত খাবার খেতে পারা মানুষটি বেঁচেছিলেন মাত্র ২৬ বছর।

সার্কাসের দলে যোগদান

তারারের পরিবার ছিলো মধ্যবিত্ত শ্রেণীর। তাদের পক্ষে তার এই বিশাল পরিমান খাদ্যের যোগান দেওয়া ছিলো অসম্ভব। আর তাই পেটের ক্ষুধার দায়ে ঘর ছাড়েন তারারে। পেটের ক্ষুধার জন্য তিনি রাস্তায় খাবার ভিক্ষা করতে শুরু করেন, কখনওবা ক্ষুধার জ্বালায় ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া মানুষের উৎচিষ্ঠ ও পচা খাবারগুলোই খুঁজে খেতে শুরু করেন। বেশ কিছুকাল এভাবে চলার পর তারারে যোগ দেন একটি সার্কাস পার্টিতে। এই সার্কাস দলটি ছিলো পকেট মারদের। তারা সাধারণ মানুষদের সার্কাস দেখানোর ছলনায় তাদের পকেট মারতো।

Image Credit: Tv tropes

বেশ কয়েকদিনের মধ্যেই তারারে সেই সার্কাস দল মানে পকেটমার দলের সকলের চোখের মূল আকর্ষণ হয়ে উঠেন। সে মঞ্চে উঠে যে কোনো কিছু খেয়ে ফেলে সাধারণ দর্শকদের দেখাতো। তারারে পাথর থেকে শুরু করে কর্ক এমনকি সে ১ ডজন আপেলও গিলে ফেলতো নিমিষেই।

এক প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনানুযায়ী, তারারে দাঁত দিয়ে জীবিত বিড়াল ছিড়ে তার রক্ত পান করতো। তারপর শুধু কঙ্কাল বাদে পুরো বিড়ালটাই গলধকরণ করে ফেলতো। একইভাবে সে কুকুরও খেয়ে ফেলতো পারতো।

বেশ কিছুকাল সার্কাসে এই কাজ করার পর তারারের পরিপাকতন্ত্রে সমস্যার সৃষ্টি হয়। আর তাকে ফ্রান্সের একটি হাসপাতালে ভর্তি করানে হয়। তার শরীরের অবস্থার কথা ভেবে ডাক্তার তাকে পরামর্শ দেয় সার্কাসে এই কাজ করা ছেড়ে দিতে। শেষমেশ তারারে সার্কাসের কাজটি ছেড়ে দেয়।

এতো এতো খাবার খাওয়ার পরও তারারের শরীরের ওজন ছিলো খুবই সাধারণ। ১৭ বছরে তার ওজন ছিলো মাত্র ১০০ পাউন্ড (প্রায় ৪৬ কেজি)। তবে তার পুরো শরীরের চামড়া ছিলো ঝুলে পড়া চামড়া। যখন সে খাবার খেতো তখন চামড়াগুলো বেলুনের মতো ফুলে উঠতো। তার মুখখানা ছিলো অস্বাভাবিক রকমের বড়। এক সাথে ১ ডজন ডিম কিংবা আপেল মুখে নিয়ে রাখতে পারতো তারারে।

Image Courtesy: Wikimedia Commons

তারারের শরীর ছিলো খুবই দূর্গন্ধ। তার আশেপাশে দিয়ে গিয়ে হেঁটেও যেতো না। খাবার খাওয়ার পর সেই দুর্গন্ধ বেড়ে যেতো আরো কয়েকগুণ। খাবার খাওয়ার পর তারারের শরীর প্রচন্ড ঘামতে শুরু করতো, আর চোখগুলো হয়ে যেতো রক্তবর্ণ। অনেকের ভাষ্যমতে খাবার খাওয়ার পর তারারের শরীর থেকে বাষ্প বের হতে শুরু করতো। এতো এতো খাবার খাওয়ার পরেও তারারের ওজন কখনো বাড়েনি। এমনকি তাকে কখনে বমিও করতে দেখা যায় নি। তবে ছোটবেলা থেকেই তার ডায়রিয়ার সমস্যা ছিলো।

সেনাবাহিনীতে তারারে

সার্কাসের কাজ ছেড়ে তারারে ফরাসী বিপ্লবী সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। তারারের অতিরিক্ত খেতে পারার সুযোগটাই কাজে লাগায় সেনাবাহিনী। তাকে কুরিয়ার হিসে ব্যবহার করা হয়, এজন্য সে গুরুত্বপূর্ণ কাগজ বা নথিপত্রগুলো গিলে ফেলতো। তবে সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার পর তারারের সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে উঠে খাবার। সেনাবাহিনীতে প্রত্যেক সেনাবাহিনীর নির্দিষ্ট পরিমান রেশন বরাদ্দ থাকে। কিন্তু যে পরিমান খাবার তারারে কে দেওয়া হতো তা ছিলো খুবই নগন্য। আর তাই খাবারের জন্য তারারে অন্য সৈনিকদের কাজ করে দিতেন।

পেটের ক্ষুধার জ্বালা নিবারন করতে তারারে ঘাস, টিকটিকি, সাপ কিংবা পোকামাকড় খাওয়া শুরু করেন। তারারের এই ক্ষুধা সমস্যা দেখে ফরাসী আর্মি তার রেশন ৪ গুন করে দিয়েছিলো। তবুও তার ক্ষুধা মেটেনি। তারারে মাঝে মাঝেই খাওয়ার অভাবে মিলিটারি হসপিটালে ভতি হতেন।

মিলিটারি হাসপাতালের দায়িত্বে ছিলেন ব্যারন পার্সি নামের এক মিলিটারি ডাক্তার। তারারের কর্মকান্ড দেখে তিনি হতবাক হয়ে যান। ব্যারন পার্সি ঠিক করেন, তিনি তারারেকে নিয়ে পরীক্ষা করবেন। আর এজন্য হাসপাতালের ১৫ জন মানুষের রান্না করা খাবার তাকে খেতে দেন।

ডাক্তারের ভাষ্যমতে, প্রায় দুটি ষাঁড়ের মাংস দিয়ে বানানো বড় বড় পাই ও চার গ্যালন দুধ একাই খেয়ে শেষ করেন তিনি। খাওয়ার পরপরই ঘুমিয়ে পড়েন তারারে। সেই সময় পার্সি তার বেলুনের মতো ফুলে যাওয়া পাকস্থলির রহস্যের কূলকিনারা করতে পারেননি।

ব্যারন পার্সি বলেন,

কুকুর এবং বিড়ালরাও তার দিকে তাকালে ভয়ে পালিয়ে গেল, যেন তারা তাদের ভাগ্য কি হতে পারে অনুমান করতে পারতো।

সেনাবাহিনীর কুরিয়ার তারারে

সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার পরেই তারারের রাইন তীরের ফরাসী আর্মি ক্যাম্পে ডাক পরে তারারের। সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করার জন্য তারা তারারের অতিরিক্ত খেতে পারার ক্ষমতাকে ব্যবহার করার চিন্তা করে। এজন্য সেনাবাহিনীর জেনারেল আলেকজান্দ্রে ডি বিউহার্নাইস একটি নথি কাঠের বাক্সের মধ্যে ঢুকিয়ে তারারের হাতে দেন এবং তা খেয়ে ফেলতে বলেন। তারা সেই কাঠের বাক্সটি গিলে ফেলেন, এর দুই দিন পর তা তার মূত্রনালী দিয়ে বের হয়ে আসে। বক্সের মধ্যে থাকা নথিটি তখনও পাঠযোগ্য অবস্থায় ছিলো।

আর এইভাবে একজন সামরিক কুরিয়ার হিসাবে কাজ করতে থাকেন তারারে, যেনো শত্রু অঞ্চলের মাধ্যমে নিরাপদে নথিপত্র বহন করতে পারে যাতে তাকে তল্লাশি করা হলে সেগুলি খুঁজে পাওয়া না যায়।

তারারের এই অদ্ভুত ও অসামান্য গুণের জন্য ফরাসি সেনাবাহিনী তাকে পুরষ্কার হিসেবে ষাঁড়ের ১৪ কেজি কাঁচা ফুসফুস দেওয়া হয়। আর তা তৎক্ষনাৎ সবার সামনে খেয়ে ফেলেন

দীর্ঘ ১ বছর তারারে সাফল্যের সাথে কুরিয়ার হিসেবে কাজ করে যাচ্ছিল। এরপরই একদিন তারারে বর্ডারে প্রুসিয়ান আর্মিদের হাতে ধরা পড়েন। তারারেকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল একজন ফরাসি কর্নেলের কাছে একটি বার্তা বহন করার জন্য। তাকে বলা হয়েছিল যে নথিগুলি অত্যন্ত সামরিক তাৎপর্যপূর্ণ, কিন্তু বাস্তবে, ডি বিউহারনাইস শুধুমাত্র একটি নোট লিখেছিলেন কর্নেল নিশ্চিত করুন যে বার্তাটি সফলভাবে গৃহীত হয়েছে, এবং যদি তাই হয়, প্রুশিয়ান সৈন্যদের গতিবিধি সম্পর্কে সম্ভাব্য দরকারী তথ্যের উত্তর দিতে।

তারারে জার্মান কৃষকের ছদ্মবেশে তারারে অন্ধকারের আড়ালে প্রুশিয়ান বডার অতিক্রম করেছিলেন। যেহেতু তারারে জার্মান বলতে পারতেন না। শীঘ্রই সে স্থানীয় বাসিন্দাদের সন্দেহের শিকার হয়। স্থানীয় মানুষজন প্রুশিয়ান কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করেন এবং প্রুসিয়ান সেনাবাহিনী তাকে বন্দী করেন।

প্রুসিয়ান সেনাবাহিনী তার শরীরে তল্লাশি চালিয়েও সন্দেহজনক কিছু পায়নি। কথা বের করার জন্য তারা তারারেকে চাবুক দিয়ে পিটিয়ে আহত করে। প্রচন্ড মার খেয়েও তারারে কোনো কথা বলেন নি। অনেক মারধর করার পর তাকে তারা একটি ল্যাট্রিনে বেঁধে রেখেছিলো। বেশ কিছুদিন প্রহার করার পর তারারেকে প্রুসিয়ানরা বর্ডারের কাছাকাছি ফেলে রেখে দেয়।

তারারের ক্ষুধা নিরাময়ের চেষ্টা

এই ঘটনার পর তারারে সেনাবাহিনীতে কাজ করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এরপর তিনি মিলিলিটারি হাসপাতালে ফেরত আসেন। তারারে ডাক্তার পার্সিকে অনুরোধ করেন, তাকে চিকিৎসা করে সাধারণ মানুষের মতো স্বাভাবিক করে দেওয়ার জন্য। পার্সি এই কাজে আগ্রহী ছিলেন তাই তারারের প্রস্তাবে রাজিও হয়ে যান।

ক্ষুধা কমানোর জন্য ডাক্তার পার্সি তারারে কে প্রথমে ক্ষুধা নিবৃত্তিকারক লুডেনাম খাওয়ান। কিন্তু এতে কাজ না হলে তাকে প্রচুর মদ ও ভিনেগার খাওয়ানো হয়। কিন্তু তাতেও কাজ না হওয়ায় তাকে প্রচুর পরিমানে নরম সেদ্ধ ডিম খাওয়ানো হয় ক্ষুধা কমানোর জন্য। এতো কিছু করার পরেও তার ক্ষুধা নিভৃত করতে ব্যর্থ হন ডাক্তার পার্সি।

তারারে হাসপাতালের বাহিরে লুকিয়ে কসাইদের ফেলে দেওয়া পঁচা মাংস খেতে থাকেন। ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া খাবার খাওয়ার জন্য তিনি কুকুরদের সাথে রিতীমত লড়াই করতেন। এছাড়াও হাসপাতালের বেশ কয়েকজন রুগীর শরীরের রক্ত পান ও করেছিলো তারারে। বেশ কয়েকবার হাসপাতালের মর্গের লাশ খেতে চাওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন তারারে। হাসপাতালের অন্য ডাক্তাররা তাকে মানসিক বিকারগস্ত মনে করছিলো তাই তাকে কোনো পাগলাগারদে পাঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিলো। কিন্তু ডাক্তার পার্সি তারারেকে নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে যেতে আগ্রহী ছিলেন, তাই তারারে মিলিটারি হাসপাতালেই ছিলেন।

এর কিছুকাল পরে হাসপাতাল থেকে ১৪ মাস বয়সী একটি শিশু হারিয়ে যায়। হাসপাতালের সকলেই এর পিছনে ধারণা করছিলো তারারে শিশুটিকে খেয়ে ফেলেছে। এই ঘটনার পর ডাক্তার পার্সির পক্ষে তারারেকে বাঁচানো ছিলো অসম্ভব। হাসপাতালের কর্মীরা তারারেকে ধাওয়া করলে সে সেখান থেকে পালিয়ে যায়, এরপর সে আর কখনো সেই মিলিটারি হাসপাতালে ফেরত আসেনি।

Image Courtesy: CVLT Nation

তারারের মৃত্যু

এই ঘটনার ৪ বছর পর ১৭৯৮ সালে ভার্সাই হাসপাতাল থেকে একজন ডাক্তার পার্সির সাথে যোগাযোগ করেন, তিনি ডাক্তার পার্সিকে জানান যে তাদের একজন রোগী তার সাথে দেখা করতে চায়। সেই রোগীটি আর কেউ নয়, সে ছিলো তারারে। তারারে ততোদিনে শরীর ভেঙে দূর্বল হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে বিছানায় পরে আছেন।

ডাক্তার পার্সিকে তারারে বলেন ২ বছর আগে তিনি একটি সোনার কাঁটা চামচ গিলে ফেলে ছিলেন আর তার জন্যই আজকে শরীরের এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তারারে আশা করছিলেন পার্সি তাকে এই অবস্থা থেকে নিরাময় করে তুলতে পারে। পার্সি পরীক্ষা করে দেখেন তারারের প্রচন্ড যক্ষ্মা হয়পছে। এর একমাস পর প্রচন্ড যক্ষ্মা আর সেই সাথে ডায়রিয়া হয়ে মৃত্যু হয় তারারের।

তারারের মৃত্যুর পর তারারের শরীরের অটোসপি করতে কোনো সার্জেন রাজি ছিলেন না। কিন্তু সেই হাসপাতালের একজন ডাক্তার টেসিয়ার কৌতুহলী ছিলেন তারারের শরীরে আদৌও কোনে সোনার কাঁটা চামচ আছে কিনা। তাই তিনি তারারের অটোসপি করতে রাজি হন। তারারের শরীর কেটে দেখা যায় তার পেট সাধারণ মানুষের তুলনায় অধিক প্রশস্ত। তারারের পাকস্থলি, খাদ্যনালী, যকৃত ও পিত্তকোষ অস্বাভাবিক রকমের বড়। আলসারে পরিপূর্ণ পাকস্থলীর সাথে পুরো শরীরের ভেতর পুঁজে ভরা ছিলো। তবে অবাক করা বিষয় হলো, তার পেটের ভেতরে থাকা সেই সোনালী কাঁটা চামচটি খুঁজে পাওয়া যায়নি। এছাড়াও আরো একটি বিষয় লক্ষণীয় ছিলো, তারারের শরীর অন্য সাধারণ মানুষের তুলনায় খুব দ্রুতই পচতে শুরু করেছিলো।

মাত্র ২৬ বছর বয়সেই মৃত্যু হয় এই অদ্ভুত মানুষটির। কেনো তার এতো ক্ষুধা ছিলো সেই রহস্য কেউ ভেদ করতে পারে নি।

Reference

  • https://en.m.wikipedia.org/wiki/Tarrare
  • Millingen, J. G. (1839), Curiosities of Medical Experience (2 ed.), London: Richard Bentley, OCLC 15518
  • Lord, Perceval B. (1839), Popular Physiology (2nd ed.), London: John W. Parker / Society for Promoting Christian Knowledge

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *