• June 26, 2025

Chalachchitra

Explore the magic of Bengali cinema and culture

ক্লিওপেট্রা: জুলিয়াস সিজার ও মার্ক অ্যান্টনির সাথে ত্রিভুজ প্রেম

রাণী ক্লিওপেট্রা ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত ও সমালোচিত ব্যক্তিত্ব। তাকে নিয়ে লেখা হয়েছে অসংখ্য কালজয়ী নাটক ও উপন্যাস। সেই তালিকায় আছেন উইলিয়াম শেক্সপিয়ার, জর্জ বার্নার্ড শ’, হেনরি হ্যাগার্ড, ড্রাইডেন প্লুটার্ক, ড্যানিয়েের মতো জগৎবিখ্যাত সাহিত্যিকরা।আশ্চর্য দক্ষতার সাথে তারা বর্ণনা করেছেন ক্লিওপেট্রার রূপ, ব্যক্তিত্ব, উচ্চাভিলাস আর কিছুটা নারীসুলভ অসহায়তা।

ক্লিওপেট্রার জন্ম যীশু খ্রিষ্টের জন্মের বহু আগে। কয়েক হাজার পেরিয়ে গেলেও তার সম্পর্কে এখনো মানুষের কৌতুহলের শেষ নেই। প্রাচীন রোমান সভ্যতা ও মিশরীয় সভ্যতার কথা তুললে তিনি তার মধ্যে চলে আসেন অনায়াসেই। এই রূপসী নারীকে নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেক কল্পকাহিনি।

ক্লিওপেট্রা ছিলেন মিশরের সর্বশেষ ফারাও। তবে তিনি জাতিগত ভাবে মিশরীয় ছিলেন না। তিনি ছিলেন টলেমিক বংশের উত্তরসূরী। গ্রীক মহাবীর আলেক্সান্ডারের মৃত্যুর পর তার একজন সেনাপতি মিশর দখল করে নেয় এবং মিশরের ক্ষমতায় টলেমিক বংশের গোড়াপত্তন করেন।

টলেমিক বংশের লোকেরা মিশর শাসন করলেও তারা কেউ মিশরীয় ভাষা শিখেন নি। তারা সকলেই গ্রীক ভাষায় কথা বলতেন। মিশরীয় ভাষা ছিলো তাদের কাছে নিম্নস্তরের ভাষা। কিন্তু বংশের ধারার বিপরীতে গিয়েই ক্লিওপেট্রা মিশরীয় ভাষা শিখেছিলেন। নিজেকে তিনি ভাবতেন একজন মিশরীয় দেবীর পুণর্জন্ম হিসেবে।

মাত্র ১৮ বছর বয়সে ক্লিওপেট্রা মিসরের সম্রাজ্ঞী হিসেবে সিংহাসনে বসেন। আর সেই সাথে মিশরীয় নিয়ম অনুযায়ী ক্লিওপেট্রা কে তারই ১০ বছর বয়সী আেন ভাই ত্রয়োদশ টলেমি কে বিবাহ করতে হয়। কিন্তু টলেমির সাথে ক্লিওপেট্রার বিরোধ চলতে থাকে। সে সময়ের মিশরের নিয়ম ছিলো সম্রাট বা সম্রাজ্ঞীর সঙ্গী থাকা বাধ্যতামূলক তাই ক্লিওপেট্রা নিজের আরেক ছোট ভাইকে বিয়ে করেন।

ইতিহাসে ক্লিওপেট্রার জীবনে বহু পুরুষের আগমন ঘটেছে, যেমন- বীর জুলিয়াস সিজার, এন্টোনি, হার্মাসীস উল্লেখযোগ্য। ক্লিওপেট্রা নিজের ক্ষমতা সুসংহত করার জন্য নিজের রূপ-কে কাজে লাগিয়েছেন বারংবার।

প্রেম, ছলনা ও ক্ষমতা

ক্লিওপেট্রা মিশরের ক্ষমতা হাতে নেয়ার পর মিশরের ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি পতন ঘটে। তাই সাম্রাজ্যকে বাঁচানোর জন্য তার বহির্বিশ্বের সাহায্য লাভ করাই একমাত্র উপায় ছিলো। আর সেই সময়ে রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার ত্রাণকর্তা হয়ে ক্লিওপেট্রার জীবনে প্রবেশ করেন।

ক্লিওপেট্রার স্বামী মানে তার ভাই তার বিরুদ্ধে নাশকতার চেষ্টা চালাতে থাকেন। তিনি সমগ্র মিশরীয় সাম্রাজ্য নিজের মুঠোয় নিতে চেয়েছিলেন এবং রাজ্যের কাউন্সিল সদস্যদের আস্থা অর্জনের জন্য প্রচুর পরিশ্রম করেছিলেন।

এই কঠিন অবস্থায় ক্লিওপেট্রা শক্তিশালী রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার কে তাকে সম্রাজ্য ধরে রাখতে সাহায্য করার জন্য রাজি করান। জুলিয়াস সিজার তখন পম্পেই কে যুদ্ধে পরাজিত করার পর আলেকজেন্দ্রিয়ায় অবস্থান করছিলেন।

 

জুলিয়াস সিজার রাণী ক্লিওপেট্রার মাথায় সাম্রাজ্যের মুকুট পরিয়ে দিচ্ছেন এই পেইন্টিং টি Pietro da Cortona ১৬৩৩ সালে এঁকেছিলেন Image source: Flickr

জুলিয়াস সিজার প্রথম দেখায় ক্লিওপেট্রার রূপ সৌন্দর্য ও বুদ্ধিমত্তার প্রেমে পড়ে যান। আর সেই প্রেমকে শারিরীক প্রেমে রূপ দিতে জুলিয়াস সিজার ক্লিওপেট্রা কে নিজের শয্যাসঙ্গী করেন। নিজের সাম্রাজ্য কে টিকিয়ে রাখতে তিনি নিজের সৌন্দর্যের যথার্থ ব্যবহার করেন এবং জুলিয়াস সিজারের থেকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি নেন। এরই মধ্যে ক্লিওপেট্রার একটি পুত্র সন্তান হলো। আলেকজান্দ্রিয়ার অধিবাসীরা তার নাম দিল সিজারিয়ান। ক্লিওপেট্রা বলতেন, টলেমি সিজার। কিন্তু সিজারের আইনসম্মত উত্তরাধিকারী এবং ভাগ্নে অক্টোভিয়ান এটা মেনে নিলেন না।

খ্রীস্টপূর্ব ৪৬ সালে ক্লিওপেট্রা তখন রোমে অবস্থান করছিলেন তখন সেনাবাহিনীর জেনারেল আন্তোনিও এর সাথে রোমান্টিক সম্পর্ক তৈরি হয়। ক্লিওপেট্রা টারসুসে (বর্তমান তুরস্ক) অ্যান্টনির সাথে দেখা করার অনুরোধ করেন। জুলিয়াস সিজার কে তিনি যেভাবে তার সৌন্দর্য ও রূপের দ্বারা প্ররোচিত করেছিলেন ঠিক সেভাবেই তিনি আন্তোনিও কেও প্রেমের জালে ফেলে নতুন পরিকল্পনা করতে থাকেন।

আন্তোনিও ক্লিওপেট্রার প্রেমে এতোটাই মজে ছিলেন যে তিনি ভুলেই গিয়েছিলে তার একজন স্ত্রী রয়েছে। ক্লিওপেট্রার সাথে ১ বছর থাকার পর ক্লিওপেট্রা আন্তোনিও এর দুইজন যমজ সন্তান (আলেকজান্ডার হেলিস ও ক্লিওপেট্রা সেলেন) এর জন্ম দেন।

তবে তাদের এই সুখের সংসার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। রোমের একপ্রান্তে তখন জুলিয়াস সিজারের ভাগ্নে অগাস্টাস তান্ডব চালাতে শুরু করেন। যখন তিনি ক্লিওপেট্রার সাথে অ্যান্টোনিও এর সম্পর্কের খবর পান, তৎক্ষনাৎ তিনি মিশরীয় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। আর ক্লিওপেট্রার প্রেমে অন্ধ অ্যান্তেনিও যুদ্ধে অংশ নেন অগাস্টাসের সৈন্যদের বিরুদ্ধে।

যুদ্ধে অগাস্টাস মিশরীয়দের পরাজিত করেন এবং রোমান সাম্রাজ্যের বিস্তার আরো দীর্ঘ করেন। এই দীর্ঘ এবং রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে, অগাস্টাস শুধুমাত্র মিশরকেই জয় করেননি, তিনি অ্যান্টনিকে পরাজিত করতেও সফল হন – এবং এইভাবে রোমান সাম্রাজ্যের প্রথম একক শাসক হন।

যুদ্ধে পরাজিত ও অপমানিত আন্তেনিও নিজের তরবারি দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন, কিন্তু রোমান পুরনো ঐতিহ্য রক্ষা করতে গিয়ে তিনি আত্মহত্যা করতে ব্যর্থ হন।

আন্তোনিও তার ক্ষতবিক্ষত দেহ নিয়ে ক্লিওপেট্রার সামনে উপস্থিত হন। ক্লিওপেট্রা তখন একটি সমাধিতে লুকিয়ে ছিলেন। অ্যান্টনিও তার প্রেমিকের কোলে তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এবং তার করুণ পরিণতি পান।

রাণী ক্লিওপেট্রার কোলে নিজের শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করছেন আন্তোনিও, ছবিটি Johann Georg Wille ১৭৭৮(1778) | Image source: Look and Learn

এন্টনির মৃত্যুর পর একা হয়ে পড়লেন ক্লিওপেট্রা।কিছুদিনের মধ্যেই ক্লিওপেট্রাকে অক্টোভিয়ানের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে অক্টোভিয়ান নিজের বিজয়ে ক্লিওপেট্রার ভূমিকা অনেকটাই হাল্কা করে দিলেন।

অক্টোবিয়ান অগাস্টাস বলেন,
মিসরের রানীর সঙ্গে তার কোনোরূপ সম্পর্ক, সমঝোতা বা বোঝাপড়ার কোনো বিষয় নেই। ক্লিওপেট্রার শাসনকাল শেষ হয়ে গেছে। এখন তাকে ক্রীতদাসী হিসেবে শহরের রাস্তায় রাস্তায় প্রদর্শন করা হবে।

তবে এরকম কিছু ঘটার আগেই ক্লিওপেট্রাকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করা হলো। ক্লিওপেট্রাকে মারার জন্য আনা হলো চরম বিষাক্ত সাপ ‘অ্যাসপ’ (মিসরীয় কোবরা। একে জীবন-মৃত্যুর ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়)। ফলের ঝুড়িতে লুকিয়ে সেই কোবরাকে আনা হলো ক্লিওপেট্রার সামনে। এই সাপের কামড়েই ৩০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের ১২ আগস্ট ক্লিওপেট্রা মারা গেলেন।

তখন ক্লিওপেট্রার বয়স ছিলো মাত্র ৩৮ বছর! ক্লিওপেট্রার মৃত্যুর সাথে সাথে মিশরের সর্বশেষ ফারাও এর শাসনের ইতি ঘটে এবং রোম বিশ্বের নতুন পরাশক্তিতে পরিণত হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *