• October 20, 2025

Chalachchitra

Explore the magic of Bengali cinema and culture

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জামাই দুর্ভোগ

জামাতাদের নিয়ে বিড়ম্বনা, দুর্ভোগ রবীন্দ্রনাথকে শ্বশুর হিসেবে অনেক বিব্রত হতে হয়েছে। সেইসব অভিজ্ঞতা বড়ই মর্মান্তিক, যন্ত্রণায় পরিপূর্ণ। অতি সংক্ষেপে রবীন্দ্রনাথের জামাই নিয়ে দূর্দশা ও জামাইদের চরিত্র সংক্ষেপে আলোচনা করছি।

১. বড় মেয়ে বেলার স্বামী শরৎকুমার চক্রবর্তী

জামাতা শরৎকুমার চক্রবর্তীর মোটেও পছন্দ ছিল না যে, শ্বশুর তার বাড়িতে আসেন। জামাইর মনোভাব জেনেও রবীন্দ্রনাথ যেতেন। মেয়ের কাছে গিয়ে বসে থাকতেন। তখন শরৎকুমার চক্রবর্তী টেবিলের ওপর পা তুলে সিগারেট খেয়ে শ্বশুর রবীন্দ্রনাথের প্রতি অপমানকর মন্তব্য করত। আর সে অপমান নীরবে সহ্য করে রবীন্দ্রনাথ দিনের পর দিন মেয়েকে দেখতে যেতেন।

এক দিন দেখতে গেছেন বেলাকে কিন্তু মাঝপথে শুনলেন বেলা যক্ষ্মারোগে মারা গেছে। মেয়ের মৃত্যু সংবাদ শুনে তিনি আর ওপরে উঠলেন না। মেয়ের শেষ মুখটি না দেখে ফিরে এলেন বাড়িতে। তার ছেলে রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন বাড়িতে এসে তার মুখে কোনো শোকের ছায়া নেই। কাউকে বুঝতে দিলেন না, কী অসহ্য বেদনার মধ্য দিয়ে তিনি সন্তানকে হারিয়েছেন ….

বড় জামাই শরৎকুমার চক্রবর্তী, বিয়ের সময় তার বয়স ৩১ বছর। তিনি শ্বশুরমশাইয়ের চেয়ে নয় বছরের ছোট, শাশুড়ি মৃণালিনী দেবীর চেয়ে চার বছরের বড়। আর স্ত্রী বেলার সঙ্গে তার বয়সের ব্যবধান ১৬ বছর। এই বিয়েতে পণ দাবি করা হয়েছিল ২০ হাজার টাকা। শেষতক রফা হয়েছিল ১০ হাজার টাকায়। তবে শর্ত ছিল, বিবাহের অন্তত তিন দিন আগে এই টাকা দিয়ে দিতে হবে। পাত্রীর তুলনায় তেমন সুদর্শন ছিলেন না পাত্র। কুলশীল বিচারেও সমান ছিলেন না।

বিয়ের পর রবীন্দ্রনাথ শরৎকে বিলাতে পাঠিয়েছিলেন ব্যারিস্টারি পড়তে। প্রতিমাসে তাকে খরচ দিতে হতো ১০ পাউন্ড, সে সময়ের হিসেবে ১৫০ টাকা। বিলাত থেকে ফিরে এসে মেয়ে এবং তার জামাই শরৎকুমার চক্রবর্তী জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে চার বছর ছিলেন। এই ঠাকুরবাড়িতে শরৎকুমার চক্রবর্তীর সঙ্গে কবির ছোট জামাই নগেন্দ্রনাথের বিবাদের সূত্র ধরে শরৎকুমার বাড়ি ছেড়ে স্ত্রীকে নিয়ে শ্রীরামপুরের পৈতৃক নিবাসে চলে যান। এরপর রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে শরৎকুমার চক্রবর্তীর সম্পর্কের ইতি ঘটে।

বিদেশ থেকে চিঠি লিখে মেয়ে ও জামাই এর সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের চেষ্টা করে করে ব্যর্থ হন রবীন্দ্রনাথ। মেয়ে ও জামাই এর মনোভাব জানতে পেরে কবি লন্ডন থেকে ক্ষমা চেয়ে জামাইয়ের কাছে চিঠি লেখেন, ‘কিছুদিন থেকে অনুভব করতে পারছি যে তোমরা কোনও কারণে আমার উপর রাগ করেছ এবং এই ব্যাপারে মনের মধ্যে খুব কষ্টও বোধ করেছি। এর ভিতরকার কারণটা কি তা আমি ভেবে স্থির করতে পারি নি, কেননা আমি ইচ্ছে করে তোমাদের প্রতি অন্যায় ব্যবহার করি নি। যদি তোমরা মনে করো থাকো যে, তোমাদের প্রতি আমার আন্তরিক স্নেহের অভাব আছে তাহলে তোমরা ভুল বুঝেছ-এর বেশি আমি আর কিছু বলতে পারি নে।’

রবীন্দ্রনাথ নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পর কলকাতা থেকে বহু লোক শান্তিনিকেতনে তাঁকে অভিনন্দন জানাতে যান। বেলা ও শরৎকুমার যাননি। বেলা ক্ষয়রোগে আক্রান্ত, এটা ধরা পড়ে ১৯১৭ সালে। নিয়মিত মেয়েকে দেখতে যেতেন রবীন্দ্রনাথ। চিকিৎসার দায়িত্বও নিয়েছিলেন।

২. দ্বিতীয় জামাতা সত্যেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য

সত্যেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ছিলেন দরিদ্র পরিবারের ছেলে। ডাক্তারি পাস করে আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা নেয়ার জন্যে পাথেয় খুঁজছিলেন। এই বিয়েতে খরচ হয় ৫০০ টাকা। রেণুকার পিতামহ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর যৌতুক হিসেবে দেন চারটি গিনি সোনা। আমেরিকায় যাওয়া ও থাকার ব্যয় নির্বাহ করা হবে বলে কোনো যৌতুক দেওয়া হয়নি বিয়েতে। জামাই এর মায়ের মাসোহারা দেয়া হতে থাকে ৫০ টাকা করে। ওই সময়ে রবীন্দ্রনাথের শাশুড়ি দাক্ষায়ণী দেবীর মাসোহারা ছিল ২০ টাকা। পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখে দেশে ফিরে আসেন মেজো জামাতা। তার ফিরে আসবার ইচ্ছা জানামাত্র রবীন্দ্রনাথ তার দেশে ফেরার খরচ পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথের অকৃতকার্যতা নিয়ে ঠাকুরবাড়ির মেয়েমহলে নানা কথা ছড়িয়ে পড়ে। তবে শ্বশুরমশাই একটি কথাও বলেননি এ ব্যাপারে। স্বামীর ব্যর্থতায় রেণুকার মন ভেঙে যায়।

যতদিন জামাই বাবাজি বিদেশে ছিলেন, ততদিন নানা অঙ্কের অর্থ পাঠাতে হয়েছে তাকে। দেশে ফিরবার পর মাসোহারা ঠিক করা হয় ১৫০ টাকা। ডাক্তারির ডিসপেনসারি সাজিয়ে দেওয়া বাবদে ব্যয় হয় ২০০০ টাকা। কিন্তু জামাই বাবাজি এক্ষেত্রেও সফল হতে পারেননি।

১৯০৩ সালে শান্তিনিকেতনে জামাতা সত্যেন্দ্রনাথকে অধ্যক্ষ নিয়োগ করেন রবীন্দ্রনাথ। এ জন্যে যথেষ্ট মূল্য দিতে হয়। বাবাজি আগের মতোই শ্বশুরের বিশ্বাসের অমর্যাদা করেন। এই জামাতার চরিত্র বৈশিষ্ট্য হলো, কোনো কাজই তিনি মন দিয়ে করতে পারতেন না। খানিকটা এগিয়ে নিয়ে মাঝপথে সেই কাজ ছেড়ে দিতেন। অধ্যক্ষ নিযুক্ত হওয়ার এক মাসের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত বিশ্বস্ত কর্মী মনোরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় বিদায় নেন শান্তিনিকেতন থেকে। পদত্যাগের কারণ দেখিয়েছিলেন ‘স্বাস্থ্যগত’, কিন্তু আসল কারণ ছিল জামাতার দুর্ব্যবহার। কাউকে কিছু না জানিয়ে ব্রহ্মচর্যাশ্রমের দায়িত্ব ত্যাগ করে জামাতা বেড়াতে চলে যান পাঞ্জাবে। স্ত্রী রেণুকা তখন অসুস্থ। রেণুকার মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ আবারও শান্তিনিকেতনে সত্যেন্দ্রনাথকে শিক্ষক হিসেবে কাজ করবার সুযোগ দেন। এমনকী তার দ্বিতীয় বিবাহেরও ব্যবস্থা করেন।

৩. ছোট জামাই নগেন্দ্রনাথ

নগেন্দ্র বরিশালের ছেলে। উচ্চশিক্ষার জন্য ইংল্যান্ড যাওয়ার বাসনা তার। ধনবানদের কাছে অর্থসাহায্য চাচ্ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের কাছে এলে ‘প্রিয়দর্শন’ নগেন্দ্রকে ভালো লেগে যায় কবির। বিদেশে যেতে ইচ্ছুক পাত্রদের পছন্দ করতেন না রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মীরা-নগেন্দ্রনাথের বিয়ের দু’বছর আগে মোহিতচন্দ্র সেনকে এক পত্রে তিনি লিখেছিলেন, ‘কোনও পাত্রকে আমি বিলেত পাঠাতে চাইওনে,পারবোও না।’ অদৃষ্টের লিখন এই যে, তিন জামাতাকেই বিলেতে পাঠাতে হয়েছিল কবিকে।

বিয়ের সময় নগেন্দ্রনাথের বয়স ছিল ১৭ বছর ৭ মাস। মীরার বয়স ১৩ বছর ৬ মাস। বিয়ে হয় শান্তিনিকেতনে, ১৯০৭ সালের ৫ জুন। খরচ হয়েছিল ২৯২৩ টাকা ৮ আনা ৬ পাই। সেই কালের হিসেবে এই খরচ বিপুল। ১১ জুন কন্যা ও জামাতা কে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বরিশালে যান। নগেন্দ্রনাথের জাহাজের টিকিট ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রবীন্দ্রনাথ কেনেন তার ভাগ্নে সত্যপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছ থেকে ৭২১ টাকা ৫ আনা ধার করে। নগেন্দ্র আমেরিকা থেকে কৃষিবিদ্যা শিখে এসেছিলেন। শ্বশুর তাকে শিলাইদহে পাঠান কৃষি গবেষণায় সাহায্য করতে। সেইসঙ্গে দিয়েছিলেন জমিদারি ও পতিসরে কৃষি ব্যাংকের কিছু কিছু দায়িত্ব। তার জন্যে মাসোহারার বন্দোবস্ত ছিল ১৫০ টাকা। ছোট জামাই অপরিমিত ব্যয়ের কারণে ঋণ করতে থাকেন। ঋণ করে বরিশালে একটি বাড়িও কেনেন তিনি।

রবীন্দ্রনাথ ১৯১২ সালে ইউরোপে যান নগেন্দ্রনাথের ওপর সংসার ও জমিদারির আর্থিক দায়িত্ব অর্পণ করে। আদি ব্রাহ্মসমাজের ট্রাস্টিগণ সমাজের সম্পাদক নিয়োগ করেন তাকে, যদিও এ সমাজের সদস্য তিনি ছিলেন না। এই সমাজের বিশ্বাস ও নিয়মাবলির ওপর জামাতার আস্থাও ছিল না। এবস্থায় জামাতার হঠকারী কার্যকলাপ, ক্ষমতাপ্রিয়তা ও অহমিকা প্রকট হয়ে ওঠে। ফলত শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের প্রধান কর্মসহায়ক অজিতকুমার চক্রবর্তীর সঙ্গে সংঘর্ষ বেঁধে যায় তার। জামাতা প্রতিটি ক্ষেত্রেই ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। আর্থিক অনিয়মও করেছেন প্রচুর। অনিয়মের ওইসব টাকার সুদ দেননি, মূলও শোধ করেননি। শেষ অবধি তা টানতে হয়েছে শ্বশুর রবীন্দ্রনাথকে।

তথ্যসূত্র : ‘রবীন্দ্র জীবনকথা’ – প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *