• June 9, 2025

Chalachchitra

Explore the magic of Bengali cinema and culture

পরিবার ও সামাজিক সচেতনতার ছবি ‘আদরের সন্তান’

আদরের সন্তান; পরিচালক – আমজাদ হোসেন; শ্রেষ্ঠাংশে – ইলিয়াস কাঞ্চন, মৌসুমী, ডলি জহুর, আবুল হায়াত, এটিএম শামসুজ্জামান, সমু চৌধুরী, সাদেক বাচ্চু প্রমুখ; উল্লেখযোগ্য গান – সময় হয়েছে ফিরে যাওয়ার, আমার আদরের সন্তান, বিয়ের তারিখ করো ফিটিং; মুক্তি – ১১ আগস্ট ১৯৯৫

মৌসুমী তখন আমজাদ হোসেনের স্ক্রিপ্টের জন্য অপেক্ষা করছিল। তার ইচ্ছা ভিন্নধর্মী কোনো গল্পে কাজ করবে। আমজাদ হোসেনের প্রস্তাবটা আসার পরে খুব উচ্ছ্বসিত মৌসুমী জানতে পারল এটা পুরোদস্তুর বাণিজ্যিক ছবি। মনটাই খারাপ হয়ে গেল তার। তবে ছবি করতে গিয়ে তার মনে হলো এ ছবিও গুরুত্বপূর্ণ কারণ এর মধ্যে আছে মেসেজ। বলছি ‘আদরের সন্তান’ ছবির নেপথ্যের একটা গল্প।

আদর্শ পরিচালক আমজাদ হোসেনের বাণিজ্যিক ছবির মধ্যেই যা থাকে অনেকে সেটা অফট্র্যাকেও পারেনি। তাঁর ‘জন্ম থেকে জ্বলছি, ভাত দে, গোলাপি এখন ট্রেনে, গোলাপি এখন ঢাকায়’ এগুলো ছিল এক একটা ক্লাসিক ছবি। ‘আদরের সন্তান’ ক্লাসিক না হলেও মনে রাখার মতো ছবি।

পরিবারের বড় ছেলের প্রতি মা-বাবার যে আশা-আকাঙ্ক্ষা থাকে সেগুলো খুব যত্ন করে তুলে ধরেছেন পরিচালক। বাবা আবুল হায়াত ছেলে ইলিয়াস কাঞ্চনের উপর নির্ভর করে। ‘বাবা কিছু হলো? আমি যে আর পারছি না।’ পরিবারের বড় ছেলে কাঞ্চন বাবার এ আর্তনাদ দেখে নিজেও অপরাধবোধে ভোগে। বেবিট্যাক্সি চালিয়ে নিজের খরচ মিটিয়ে বাড়িতে টাকা পাঠানোর কথা তাকে ভাবতে হয়। তার সাথে ঘরে আছে বিবাহযোগ্য বোন। বাস্তবসম্মত গল্পের একটা উপস্থাপন প্রথম থেকেই ছবিতে থাকে। ছবিটি পরিবারের এক আদরের সন্তানের সামাজিক অবস্থান দেখায় অনেক ঘটনার মাধ্যমে।

সমাজের প্রচলিত অপরাধের ফলে অনেক পরিবারে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্যোগ আসে। কাঞ্চনের পরিবারে সেটাই আসে। মৌসুমীকে রাতের বেলা ছিনতাইকারী আটকালে ঘটনাক্রমে বাঁচায় কাঞ্চন। কিন্তু মৌসুমী উল্টো তাকেই অপরাধী মনে করে চিৎকার করতে থাকে-‘হাইজ্যাকার, হাইজ্যাকার’ বলে। গণধোলাই ও আইনের হাতে পড়ার পরে সামাজিক সস্মান নষ্টের পর বাবা আবুল হায়াতের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। মা ডলি জহুর ছেলের মুখ দেখা বন্ধ করলে পরিবারের সাথে সম্পর্কের দূরত্ব তৈরি হয়। প্রচলিত অপরাধের বলি হয়ে অনেকের জীবন পাল্টে যায় যেভাবে তার একটা নজির আছে ছবিতে।

সামাজিক অপরাধের বিপরীতে প্রতিশোধের বিষয়টি স্বাভাবিক ঘটনা। কাঞ্চন প্রতিবাদী হয়ে ওঠে মৌসুমীর উপর। মৌসুমীও পাল্টা প্রতিশোধের চেষ্টা করে। কাঞ্চন খেতে বসলে ভাতে বালু ছিটিয়ে দেয় মৌসুমীর ভাড়া করা গুণ্ডার দল। মদের নেশায় পড়ে দুজন দুইভাবে রাগ প্রকাশ করে। কাঞ্চন-মৌসুমী দ্বন্দ্ব জমে ওঠে ছবিতে। মানুষ তার বিপরীত শত্রুর প্রতি তার প্রবৃত্তিগত যে ক্ষোভ প্রকাশ করে মৌসুমী-কাঞ্চন তা দেখায়।

  • কত টাকা হলে তোমার বাড়ি বয়ে এসে এসব অসভ্যতামি যাবে? এই নাও চেক। অঙ্কটা বসিয়ে দাও।
  • দেখুন ক্যাশ করাতে পারবেন কিনা।
    চেকবইতে লেখা ছিল-‘আমার বাবাকে ফেরত চাই।’ মৌসুমীর ভুল ভাঙা, অপরাধবোধ বা অনুশোচনায় ভোগার জন্য এ কথাটাই টার্নিং পয়েন্ট। অপরাধ করে অনুশোচনায় ভুগে তারপর নিজের অপরাধের বিপরীতে যার ক্ষতি হয়েছে তার ক্ষতি পুষিয়ে দেবার চিন্তা করাটা সামাজিক সচেতনতার অংশ। সমাজে কত মানুষই তো কত মানুষের ক্ষতি করছে কজনই ক্ষতিপূরণ দেয়! মৌসুমীর চরিত্রটি এই গুরুত্বপূর্ণ দিকটিকে তুলে ধরে। কাঞ্চনের সাথে মিশে তাকে কথা দিয়ে গ্রামের বাড়ি পর্যন্ত চলে যায় সে। তারপর ডলি জহুরকে সব খুলে বলে। ভাঙা সম্পর্ক জোড়া লাগার প্রক্রিয়া শুরু হয়।

বাবা-মেয়ের খুনসুটি, রাগ, ভালোবাসার দারুণ নিদর্শন ছিল এটিএম শামসুজ্জামান ও মৌসুমী। এটিএম বাইরের হোটেলে খায় এটা মেয়ের পছন্দ না। মৌসুমী ক্ষেপে গেলে এটিএমের অবস্থা কাহিল। মৌসুমী মদ খেয়ে বাড়ি ফেরার পরদিন এটিএম শিশুর মতো কাঁদে মেয়ের কান্ড দেখে। মৌসুমী তখন ক্ষমা চায়। শাড়ি পরে বাবার সামনে দাঁড়ালে এটিএম বলে-‘অনেকদিন পর মনে হইতাছে তোর মা এ বাড়িতে ফিরা আসছে।’ মেয়ের পছন্দমতো বিয়ে দেবে জানায়।

  • পছন্দ করেছি।
  • কে?
  • বেবিট্যাক্সিওয়ালা
    অসাধারণ ছিল বাবা-মেয়ের সম্পর্কের উপস্থাপন।

ছবিতে গ্রামের প্রচলিত সমস্যার কিছু উপস্থাপন আছে। সমু চৌধুরী বখাটে ছেলে যে কাঞ্চনের বোনকে বিরক্ত করে। বোনের বিয়ের কথা উঠলে মৌসুমীর উপস্থিতিতে যৌতুকের কথা তোলে ঘটক। গ্রামের বিয়েতে যৌতুক কমন বিষয়। গুরুত্বপূর্ণ ছিল বিষয়গুলো।

ছবিতে টাচি সিকোয়েন্স আছে কয়েকটি-
১. কাঞ্চন মৌসুমীকে ছিনতাই থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করলে উল্টো তাকেই দোষী করে মৌসুমী। কাঞ্চন চিৎকার করে-‘আমি হাইজ্যাকার নই।’ অসাধারণ অভিনয়।
২. সাদেক বাচ্চু তার ছেলে সমুর সাথে আবুল হায়াতের মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব দিলে রাজি হয় না আবুল হায়াত। তখন সাদেক বাচ্চু লাথি মেরে ফেলে দেয় আবুল হায়াতকে। গড়িয়ে পড়ে একটা খাদে। মর্মান্তিক ছিল।
৩. মৌসুমী ডলি জহুরের পা ধরে ক্ষমা চায় আর কাঞ্চনের কষ্টের কথা বলে। ডলি জহুর প্রথমে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে পরে মৌসুমীকে বুকে টেনে নেয়। বলে-‘আমার ছেলে কোথায়? ওরে আমি কতদিন দেখি না।’ ডলি জহুর ও মৌসুমী দুজনই অসাধারণ তখন।
৪. মৌসুমী ফিরে গিয়ে কাঞ্চনকে জানায় মা তাকে দেখতে চেয়েছে। সেসময় কাঞ্চনের আনন্দ অশ্রুর প্রকাশ অনবদ্য।
এভাবে সবার প্রাণবন্ত অভিনয়ে ছবিটি অভিনয়সমৃদ্ধ।

ছবির গানের মধ্যে ‘সময় হয়েছে ফিরে যাওয়ার / মন কেন যেতে চায় না’ এ গানটি বহুল জনপ্রিয়। গানে মৌসুমীর সৌন্দর্যে চোখ আটকে যায়। গানটিতে ঝড়ের পরিবেশ তৈরি দারুণ। ‘আমার আদরের সন্তান’ টাইটেল ট্র্যাকটি টাচি। ‘টিটিং টিটিং বিয়ের তারিখ করো ফিটিং’ এ গানটি রেডিওতে বেশ বাজানো হত। মাকসুদের ‘মৌসুমী কারে ভালোবাসো তুমি’ গানটি কিছুক্ষণ থাকে ছবিতে। মৌসুমীর ড্রাইভিং-এর সময় তখন সে মৃদু হাসে।

‘আদরের সন্তান’ ছবি মোটের উপর ফ্যামিলি ড্রামা উইথ সোশ্যাল কনসাসনেস। সমাজের প্রচলিত অপরাধে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে যার দ্বারা ক্ষতি হয় তা পাশে থাকা তার কর্তব্য। এই গুরুত্বপূর্ণ দিকটি ছবির মেসেজ। আমজাদ হোসেন বাণিজ্যিক ছবির মধ্য দিয়ে দর্শককে মেসেজটা দিয়েছেন সফলভাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *